২০২৬ গঙ্গাচুক্তির নবীকরণ কি আদৌ মানবেন মমতা? কী বলছে ‘দুই-বাংলা’?

স্বর্ণার্ক ঘোষঃ  এক দশক পেরিয়ে গিয়েছে, নদীর জল বন্টন ইস্যুটি এখনও ঝুলে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে। তিস্তা নদীর জল থেকে…

গঙ্গা নদী চুক্তি নবীকরণ

স্বর্ণার্ক ঘোষঃ  এক দশক পেরিয়ে গিয়েছে, নদীর জল বন্টন ইস্যুটি এখনও ঝুলে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে। তিস্তা নদীর জল থেকে গঙ্গা চুক্তির নবীকরণ। কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতায় আটকে নদীর জল বন্টন। ২০১১ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর এই তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের দিকে জোর দিয়েছিল তদকালীন ইউপিএ-২ সরকার। ঢাকায় গিয়ে সেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনাকে সেই আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কিন্তু বাধ সাধেন সেইসময় সদ্য ক্ষমতায় আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়। এই দুই দেশের নদীর জল বন্টনের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গকে জানানো হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নদীর জলের ওপর প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব অধিকার রয়েছে। সুতরাং নদীর জল সংক্রান্ত কোনও চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মতামত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থ্যাত্ রাজ্যের সম্মতি ছাড়া কোনওভাবেই এমন চুক্তি সাক্ষর সম্ভব নয়। এই যুক্তিতেই তদকালীন মনমোহন সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার ফলে বিশবাঁও জল চলে যায় ওই চুক্তিটি।

   

এরপর গঙ্গা-যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কেন্দ্রে মনমোহন সিং-য়ের বদলে ক্ষমতায় এখন নরেন্দ্র মোদী। বিগত দশ বছর ধরে তিনিই এখনও দিল্লির মসনদে রয়েছেন। সম্প্রতি লোকসভা ভোটে জিতে তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি। আর তারপরেই গত সপ্তাহে ভারত সফরে আসেন প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনা। দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে প্রায় দশটি বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। আর সেই প্রসঙ্গেই ফের উঠে আসে নদীর জলবন্টনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টিও।

বেকারত্বের লং জাম্প! তৃতীয়বার মোদী কুর্সিতে বসতেই চরম সর্বনাশ

আর দু বছর পর ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির নবীকরণ নিয়েও কথা হয়েছে দু-পক্ষের। পূর্ব নির্ধারিত চুক্তি মেনেই গঙ্গার জল বন্টন করা হবে কিনা তা এই চুক্তির ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু এবার এই চুক্তি নবীকরণের ক্ষেত্রে রাজ্যকে ‘বঞ্চনা’ করা হতে পারে বলে অভিযোগ তোলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সমস্ত নদীর জল ওপার বাংলায় চলে গেলে এরাজ্যের ক্ষতি হতে পারে বলে দাবি করেন তিনি। সেই মর্মে একটি চিঠিও দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। ফলে কিছুটা হলেও নয়াদিল্লিকে ‘অস্বস্তিতে’ পড়তে হয়েছে বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ওমপ্রকাশ মিশ্র বলেন,” ভারত একটি যু্ক্তরাষ্ট্রীয় দেশ। এখানে রাজ্যের নদীর জল সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজ্যের সম্মতি নেওয়া প্রয়োজন। রাজ্যেকে বাদ দিয়ে এই সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্র কখনও কোনওরকম চুক্তি সাক্ষর করতে পারেনা। নদীর জল বন্টন নিয়ে দু-দেশের মধ্যেই দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। আগামী দিনে দুই প্রতিবেশী দেশই নিশ্চই একটি সমাধান সূত্রে পৌঁছবে।”

প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী এইচ. ডি দেবগৌড়ার আমলে ১৯৯৬ সালে এই গঙ্গা চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়েছিল তদকালীন প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনার সঙ্গে। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। তিরিশ বছরের জন্য এই চুক্তির সময়সীমা ছিল। সেই সূত্রে আগামী দু-বছর পর ২০২৬ সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। আর তারপর কী হবে? আবার ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। তখন সেই চুক্তির নবীকরণ হলে কী আদৌ মেনে নেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? সেই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

এই প্রসঙ্গে নদী বিশেষঞ্গ সুপ্রতীম কর্মকার বলেন,”নদীর জল বন্টনের বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশ ভারতের জলবন্টন নিয়ে যে অভিযোগ করে সেটা একতরফা নয়। বিগত কয়েক বছরে আত্রেয়ী, কুলিক ও যমুনা নদীর ওপর বাঁধ দিয়েছে বাংলাদেশ। যারফলে এপারেও নদীর জলের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।”

১৯৯৬ সালে সাক্ষরিত গঙ্গার ফারাক্কা চুক্তিতে কী বলা হয়েছিল?

জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গঙ্গা নদীর ৪০০০০ কিউবিক সেক ভারত পাবে। বাকি জল পাবে বাংলাদেশ।
মার্চ ও এপ্রিল আবার ৪০০০০ কিউবিক সেক জল পাবে বাংলাদেশ। এবং বাকি জল পাবে ভারত।
আবার, গরমকালে মে মাসে প্রথম ২০ দিন ৩৫০০০ কিউবিক সেক জল ভারত পাবে, এবং পরবর্তী ১০ দিন ওই পরিমাণ জল পাবে বাংলাদেশ। তারপর বাকি ছয় মাস একই ভাবে জল বন্টন হবে দু-দেশের মধ্যে।

এই নীতি অনুযায়ী গত কয়েক দশক ধরে জল বন্টন হয়ে এসেছে দু-দেশের মধ্যে। এখন এই গঙ্গা চুক্তির নবীকরণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় জল্পনা বেড়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশেও। ইতিমধ্যেই বিগত এক দশক ধরে তিস্তার জল বন্টন নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বেড়েছে সেই দেশে। তারমধ্যে গঙ্গা চুক্তির ইস্যুটি কোন দিকে মোড় নেয় সেটাই দেখার।

বেকারত্বের লং জাম্প! তৃতীয়বার মোদী কুর্সিতে বসতেই চরম সর্বনাশ

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায় বলেন, “দু-দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় মিত্র রাষ্ট্র হিসেবে রক্ত দিয়েছে ভারত, কিন্তু কিছু মানুষ দু-দেশেই রয়েছে, যারা চায় না দুই দেশের সম্পর্ক মজবুত হোক।” পাশাপাশি নদীর জল বন্টন নিয়ে তিনি বলেন, “ভারত ও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চুক্তি মেনেই সীমানা চুক্তি সাক্ষরিত করে। যা দুই রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। সেই রকম আগামী দিনেও দুই দেশ কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে নদীর জল বন্টনের বিষয়টিও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করবে।”