বিজেপির (BJP West Bengal) প্রাক্তন এবং বর্তমান রাজ্য সভাপতির মধ্যে বন্ধুত্ব কি ক্রমশই গাঢ় হচ্ছে? অন্তত সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সেদিকেই ইঙ্গিত করছে (BJP West Bengal)। এই জল্পনা আরও তুঙ্গে ওঠে যখন দিলীপের পুরোনো কেন্দ্র মেদিনীপুরের খড়্গপুরে একটি সভায়। বিজেপির (BJP West Bengal) আয়োজিত একটি রক্তদান শিবিরে এবং সংবর্ধনা সভায় দিলীপ ঘোষের সঙ্গে উপস্থিত হন বর্তমান রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। সদ্যজয়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্তকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য আয়োজন করা হয় এই বিশেষ সভার। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে দিলীপকে পাশে রেখেই বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন সুকান্ত।
সুকান্ত বলেন ” অনেক সময় দেখতে পারি যাকে প্রার্থী করা হয়েছে পছন্দ হয়নি, পার্টি যে পার্টি যে সবসময় ঠিক কাজ করে তা তো নয়, হয়তো একটা সিটের জন্য ৫০ জন দাবীদার। একজনকে টিকিট দিলেই বাকি ৪৯ জন তখন বিরোধী হয়ে যায়। এই রোগ থেকে বেরোতে হবে। ” এটুকু অব্দি ঠিকই ছিল। কিন্তু তারপর পরবর্তী যে বক্তব্যটা সুকান্ত রাখলেন তাতেই শুরু হয়ে গেল জল্পনা।
সুকান্তের গলায় তখন দিলীপের প্রশংসা। তিনি বলতে থাকেন, “২০১৪ সালে দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে যেভাবে আমরা একজোট হয়ে লড়াই করেছিলাম, আমার বিশ্বাস সেই লড়াইয়ে যদি আমরা ফিরতে পারি, তাহলে আবারও পশ্চিমবঙ্গের বুকে আমরা গেরুয়া পতাকা ওড়াতে পারব”। সুকান্তর এই বক্তব্যেই এবার নতুন করে জল্পনা শুরু হল।
না থেকেও আছেন তিনি! রাজ্য কমিটির বৈঠকের আগে শুভেন্দুদের মাথাব্যথা দিলীপই?
রাজনীতিতে প্রচলিত কথাই হল, কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কথাকে ধরতে পারা। ২০১৪ সালের পর ২০১৯ সালে দিলীপ ঘোষ সভাপতি থাকাকালীন বঙ্গে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছিল বিজেপি। বিজেপির অনেক পুরোনো নেতার বক্তব্য, সংগঠনটাকে বেশ ভালো রকম ভাবে গুছিয়ে তৈরি করেছিলেন দিলীপ ঘোষ। কিন্তু ২০২১এ ব্যর্থতার দায় কাধে নিয়ে তাঁকে একরকম বনবাসেই পাঠিয়ে দেয় বিজেপি।
তাঁর জায়গায় বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত সভাপতি হয়ে আসেন। সুকান্তের হাতেও ক্ষমতার কোনো রাশ ছিল না। ২০২১ এর পর থেকে বঙ্গ বিজেপিকে চালিয়েছেন বিরোধী দলনেতা তথা শুভেন্দু অধিকারী এমনটাই বক্তব্য অনেকের। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে একই ইস্যু নিয়ে কর্মসূচিতে আলাদা আলাদাভাবে আন্দোলন বা সভা করেছেন শুভেন্দু এবং সুকান্ত।
লোকসভা ভোটের আগে সন্দেশখালি ইস্যুতেও একই ট্রেন্ড নজরে এসেছিল সবার। টাকিতে আন্দোলন করবার সময় আহত হয়ে অসুস্থ হওয়াতে তড়িঘড়ি হসপিটালে ভর্তি করতে হয় সুকান্তকে। আবার শুভেন্দুও সন্দেশখালি নিয়ে নিজের মত করে আদালত কেন্দ্রিক রাজনীতি চালিয়ে গিয়েছেন বরাবর।পরবর্তীকালে লোকসভা চলাকালীন তৃণমূলের একাধিক ভাইরাল ভিডিও প্রকাশ করে। সেখানে সন্দেশখালি নিয়ে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে নেপথ্যের নায়ক হিসাবে নাম উঠে আসে শুভেন্দু অধিকারীর। বিজেপির অনেক নেতার মতেই লোকসভায় সন্দেশখালি ইস্যু যে কারণে উল্টে ব্যাকফায়ার করেছে বিজেপিকেই।
এমনকী বঙ্গ বিজেপির হেভিওয়েট ত্রিমূর্তি শুভেন্দু সুকান্ত এবং দিলীপকে আজ অব্দি কটা মঞ্চে একসাথে দেখা গিয়েছে তা বোধহয় কেউই মনে করতে পারবেন না। ফলে কোথাও না কোথাও শুভেন্দু সুকান্তর দ্বন্দ্বের চোরা স্রোত ছিল বলেই অভিমত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের পর দিলীপ হোক কিংবা সুকান্ত, দুজনেই যেন ওপেন হ্যান্ড ব্যাটিং শুরু করেছেন।
পোর্টাল খুলে ১০০ জনকে নিয়ে আবারও শুভেন্দুর অভিযান! পদ্মবনের অধিকার বাঁচাতে রাজভবনই ভরসা?
২৪ শে নির্বাচনে শুভেন্দুর ক্যাপ্টেন্সিতেই লড়াইয়ে নেমেছিল বঙ্গ বিজেপি। বলা হয় ৪২ টি কেন্দ্রের প্রার্থীর মধ্যে ২৪ টি নাকি শুভেন্দুরই পছন্দের। সাধারণত বিজেপির প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হয় কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনার ভিত্তিতে। সূত্রের খবর প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই শুভেন্দু কে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল।
শুভেন্দুর নির্বাচিত প্রার্থীই কি তাহলে পছন্দ ছিল না সুকান্তর? সেই চাপা অসন্তোষই কী মেদিনীপুরের মঞ্চে বকলমে বলে ফেললেন বর্তমান রাজ্য সভাপতি? তবে জল্পনার অঙ্ক কিন্তু এখানেই শেষ নয়? বিজেপির গঠনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী খুব তাড়াতাড়ি রাজ্য সভাপতির পদ ছাড়তে হবে সুকান্ত কে। ইতিমধ্যেই অভ্যন্তরে দিলিপের সমর্থনে জেরালো হাওয়া উঠেছে। মেদিনীপুরের রক্তদান শিবিরে ২০১৪ এর কথা মনে করিয়ে দিয়ে কোথাও না কোথাও সেই হাওয়াকে কি সমর্থন করলেন সুকান্ত?
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, শুভেন্দু অধিকারী অনুগামীরা এই রক্তদান শিবিরে কেউই আসেননি। ফলে কার্যত এই রক্তদান শিবির দিলিপপন্থীদেরই আয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে।এই রক্তদান শিবিরেই উপস্থিত বিজেপি কর্মীদের কাতর আবেদন ছিল সুকান্তের কাছে। রীতিমতন সংবাদ মাধ্যমের সামনেও তারা চেঁচিয়ে স্লোগান দেন। তাঁদের একটাই বক্তব্য ছিল দিলীপ ঘোষকে যে করে হোক রাজ্য সভাপতির পদে ফেরত আনতে হবে।
২০২৪ এ দিলীপের জেতা লোকসভা আসন মেদিনীপুর থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই জায়গায় প্রার্থী করা হয় অগ্নিমিত্রা পলকে। অনেকেই বলেন শুভেন্দু অধিকারী যথেষ্ট অনুগত এই অগ্নিমিত্রা। কিন্তু তাতও মেদিনীপুরে তৃণমূলের জুন মালিয়ার কাছে হার স্বীকার করতে হয় অগ্নিমিত্রাকে। অপরদিকে বর্ধমান দুর্গাপুরে প্রচারের ঝড় তুলেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে দিলীপকে। প্রার্থী নিয়ে যে দু তিন লাইন কথা সুকান্ত বলেছেন, তাতে কি এই মেদিনীপুরের অঙ্কও তার মাথায় ছিল? সেই সম্ভাবনাও খারিজ করে দেওয়া যায় না।
আপাতত বর্তমান রাজ্য সভাপতি এবং প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দুজনেই সংঘের ঘনিষ্ঠ বলেই জানা যায়। তাই সুকান্তও চাইবেন তাঁর ছেড়ে দাও যাওয়া পদে, সংঘ ঘনিষ্ঠ বা সংঘের অনুগামী কেউই বসুক। সেক্ষেত্রে দিলীপ ঘোষ তাঁর প্রথম পছন্দ হতেই পারেন। অপরদিকেই দিল্লি বা নাগপুর থেকেও তিনি কি সম্ভাব্য কোন ইঙ্গিত পেয়েছেন দিলীপ ঘোষ কে নিয়ে। খোলা মঞ্চে দিলীপের এহেন প্রশংসা কিন্তু সেই অঙ্ককেও উস্কানি দিচ্ছে।
এর আগে অবশ্য দিলীপ ঘোষকে নিয়ে এত উদার প্রশংসা করতে দেখা যায়নি সুকান্তকে। আবার একই মঞ্চে দুজন উপস্থিত এরকম চিত্র অতি বিরলই বলা যেতে পারে। তাহলে কি প্রাক্তন এবং বর্তমান রাজ্য সভাপতি জোট বাঁধছেন বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে? মুখে না বললেও সুকান্তর এই সংবর্ধনা তথা রক্তদান শিবিরে রাখা বক্তব্য, শুভেন্দুর রক্তচাপ অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।