শসায় নতুন রোগের হুমকি! বাংলার কৃষকদের জন্য সতর্কতা ও প্রতিরোধ

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য শসা (Cucumber) চাষ একটি লাভজনক কৃষি কার্যক্রম হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে শসা ফসলে নতুন রোগের হুমকি দেখা দিয়েছে। এই রোগগুলি শসার ফলন এবং…

New Disease Threat in Cucumber Crops: Bengal Farmers Urged to Act

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য শসা (Cucumber) চাষ একটি লাভজনক কৃষি কার্যক্রম হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে শসা ফসলে নতুন রোগের হুমকি দেখা দিয়েছে। এই রোগগুলি শসার ফলন এবং গুণমানের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, যা কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। ২০২৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং কৃষি পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে শসা ফসলে বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকজনিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের এই রোগগুলির প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। এই প্রতিবেদনে আমরা শসা ফসলে নতুন রোগের হুমকি, এর লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে আলোচনা করব।

শসা ফসলে প্রধান রোগের হুমকি
শসা ফসলে বেশ কিছু রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

   
  • মোজাইক ভাইরাস (Cucumber Mosaic Virus): এই ভাইরাসটি এফিড (Aphid) নামক পোকার মাধ্যমে ছড়ায়। আক্রান্ত গাছের পাতায় হলুদ ও সবুজ রঙের মোজাইক প্যাটার্ন, ছোট পাতা এবং বিকৃত ফল দেখা যায়। গুরুতর আক্রমণে ফুল ফোটা বন্ধ হয়ে যায় এবং ফলন কমে যায়।
  • ডাউনি মিলডিউ (Downy Mildew): ছত্রাকজনিত এই রোগ পাতার নিচের দিকে ধূসর-সাদা ছত্রাক সৃষ্টি করে। পাতায় হলুদ দাগ দেখা যায়, এবং গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এটি আর্দ্র ও উষ্ণ আবহাওয়ায় দ্রুত ছড়ায়।
  • ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট (Bacterial Wilt): রালস্টোনিয়া ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট এই রোগে গাছ হঠাৎ শুকিয়ে যায়। পাতা এবং কাণ্ডে পানির অভাবের লক্ষণ দেখা যায়, এবং গাছ মারা যায়।
  • অ্যানথ্রাকনোজ (Anthracnose): কোলেটোট্রিকাম ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট এই রোগে পাতায় হলুদ বা পানির মতো দাগ এবং ফলে ডুবে যাওয়া দাগ দেখা যায়। এটি ফলনের গুণমান নষ্ট করে।
  • ফ্রুট ফ্লাই (Fruit Fly): এই পোকা শসার ফলের নিচে ডিম পাড়ে, যার ফলে ফল পচে যায় এবং ঝরে পড়ে।

বাংলার কৃষকদের জন্য হুমকি
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল, যেমন হাওড়া, হুগলি, এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা, শসা চাষের জন্য উপযুক্ত। তবে, আর্দ্র জলবায়ু এবং ঘন ঘন বৃষ্টিপাত এই রোগগুলির বিস্তারে সহায়ক। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার পরিবর্তন এই রোগগুলির প্রকোপ বাড়িয়েছে। এছাড়াও, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় শসা চাষে রোগের প্রভাব বেশি দেখা যাচ্ছে, কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে নতুন প্যাথোজেন ভারতে প্রবেশ করছে।

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়
বাংলার কৃষকদের এই রোগগুলি নিয়ন্ত্রণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে:

Advertisements
  • প্রতিরোধী জাতের ব্যবহার: রোগ প্রতিরোধী শসার জাত, যেমন পাঞ্জাব নবীন বা পাঞ্জাব খিরা-১, ব্যবহার করা উচিত। এই জাতগুলি রোগের প্রভাব কমায়।
  • বীজ শোধন: বীজ বপনের আগে ক্যাপটান (২ গ্রাম/কেজি বীজ) বা প্রোভ্যাক্স ২০০ দিয়ে শোধন করতে হবে। এটি বীজবাহিত রোগ প্রতিরোধ করে।
  • ফসল ঘূর্ণন: শসার সঙ্গে ভুট্টা বা অন্য অ-হোস্ট ফসলের ঘূর্ণন রোগের ঝুঁকি কমায়। কমপক্ষে ২-৩ বছরের ফসল ঘূর্ণন পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।
  • জৈব নিয়ন্ত্রণ: এফিড এবং ফ্রুট ফ্লাই নিয়ন্ত্রণে নিম তেল (৩%) বা জৈব কীটনাশক, যেমন বোভেরিয়া বাসিয়ানা, ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও,
  • পরজীবী ওয়াস্প (যেমন ডিগ্লিফাস ইসায়া) পোকা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
  • সঠিক সেচ ব্যবস্থা: ড্রিপ সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করলে পানি পাতায় ছড়িয়ে পড়ে না, যা ছত্রাকজনিত রোগ কমায়। প্রতি ৪-৫ দিন অন্তর সেচ দেওয়া উচিত।
  • পরিষ্কার কৃষি: আক্রান্ত গাছ অপসারণ ও ধ্বংস করা এবং ক্ষেত পরিষ্কার রাখা রোগের বিস্তার রোধ করে। ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটিতে রাখা যাবে না।
  • রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ: ডাউনি মিলডিউ এবং অ্যানথ্রাকনোজের জন্য ক্লোরোথ্যালোনিল বা রিডোমিল (২ গ্রাম/লিটার পানি) স্প্রে করা যেতে পারে। তবে, রাসায়নিক ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

বাংলার কৃষকদের জন্য পরামর্শ
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বিভাগ এবং কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (কেভিকে) কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ প্রদান করছে। কৃষকদের উচিত স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রোগ শনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা। এছাড়াও, আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন ড্রোন এবং মেশিন ভিশন, শসা ফসলে রোগ শনাক্তকরণে সহায়ক হতে পারে। ২০২৫ সালে সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে শসার রোগ ৮৭.৫% নির্ভুলতার সঙ্গে শনাক্ত করা সম্ভব।

শসা ফসলে নতুন রোগের হুমকি বাংলার কৃষকদের জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ। তবে, সঠিক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এই হুমকি মোকাবেলা করা সম্ভব। রোগ প্রতিরোধী জাত, ফসল ঘূর্ণন, জৈব নিয়ন্ত্রণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষকদের ফলন এবং আয় সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক হবে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের উচিত স্থানীয় কৃষি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া এবং সতর্কতার সঙ্গে শসা চাষে মনোনিবেশ করা। এই পদক্ষেপগুলি শুধু ফসলের ক্ষতি কমাবে না, বরং কৃষকদের আর্থিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করবে।