ইস্টবেঙ্গলের ‍‘বাতিল ঘোড়া’ চিমা একটা সময় ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন!

ভারতে পা রাখার আগেই লাইমলাইটে চলে এসেছিলেন তিনি। এর অন্যতম কারণ ছিল, ভারতেই খেলে যাওয়া অন্যতম সেরা বিদেশির সঙ্গে নামের মিল। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, চিমার…

ভারতে পা রাখার আগেই লাইমলাইটে চলে এসেছিলেন তিনি। এর অন্যতম কারণ ছিল, ভারতেই খেলে যাওয়া অন্যতম সেরা বিদেশির সঙ্গে নামের মিল। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, চিমার কথাই বলা হচ্ছে।
ড্যানিয়েল চিমা চুকুউ। বেশি পরিচিত চিমা নামেই। ইস্টবেঙ্গলের হাত ধরে ভারতে এসেছেন তিনি। যেমনটা করেছিলেন চিমা ওকেরি। মোহনবাগানে কেরিয়ারের সোনালী অধ্যায় অতিক্রম করলেও, নাইজেরিয়ার সেই চিমাও কিন্তু ভারতে এসেছিলেন লাল-হলুদ ক্লাবের সৌজন্যেই। তারপর নিজের গোলস্কোরিং ক্ষমতা মেলে ধরে এদেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু চিমা চুকুউ সেই অর্থে প্রথম পরীক্ষায় ডাহা ফেল। ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ। ফলস্বরূপ মরসুমের মাঝপথেই ক্লাব ছেড়ে দিয়েছে তাঁকে। আর এই ঘটনা চিমাকে এতটাই আঘাত দিয়েছিল যে, একটা সময় ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার নীল নকশা কষে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগেই জামশেদপুর এফসির প্রস্তাব আসে। দ্বিতীয়বার ভাবেননি জামশদপুরে সই করতে।

তবে এই ঘটনার জন্য ইস্টবেঙ্গলকে কাঠগড়ায় তুলতে নারাজ চিমা। উলটে, নিজে যে সেরা পারফরম্যান্স মেলে ধরতে পারেননি, সেকথাই স্বীকার করে নিলেন চিমা। তিনি জানান, লাল-হলুদ ব্রিগেডের ব্যর্থতা তাঁকেও ব্যক্তিগত ভাবে প্রভাবিত করে। যার ফলে তিনি মাঠে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দিতে পারেননি। এর জেরে মাঠের বাইরে মানসিক ভাবে যথেষ্ট চাপেও পড়ে যান চিমা।

আশির দশকে নাইজেরিয়া থেকে এসে কলকাতার ফুটবলে ঝড় তুলেছিলেন চিমা ওকোরি। ভারতীয় ফুটবলে খেলা বিদেশিদের মধ্যে অন্যতম সেরা এই নামের আর এক জন আসায় ড্যানিয়েল চিমার কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল কলকাতার ক্লাব ও তাদের সমর্থকদের। তার ওপর এই চিমা ফুটবল জীবনে অনেক সাফল্যও পেয়েছেন। তিন বার নরওয়ের প্রথম ডিভিশন ক্লাব মোল্ড এফকে-র লিগ চ্যাম্পিয়ন দলে ছিলেন চিমা। চার বছর লিগে অংশ নিয়ে তিনবারই চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। ১৩ গোল করে ২০১৩-য় সেই ক্লাবের সর্বোচ্চ স্কোরারও হয়েছিলেন। ২০১১ থেকে ২০১৪— এই চার বছর বর্তমান ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড কোচ ওলে গানার সোলজসারের তত্ত্বাবধানেও ছিলেন তিনি। ওই চার বছর মোল্ডের কোচের দায়িত্বে ছিলেন সোলজসারই।

এ রকম একজন ফরোয়ার্ডের কাছ থেকে ভাল কিছু আশা করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ চিমা। এসসি ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে সম্প্রতি জামশেদপুর এফসি-তে যোগ দেওয়ার পর তিনি বলেন, “কিছু ব্যাপার একেবারেই ঠিকমতো হয়নি। আমি যখন ভারতে এসে পৌঁছই, তখন কোনও সমস্যা ছিল না। তখন সব কিছুই ভালো চলছিল। কিন্তু যখনই ক্লাব খারাপ ফল করা শুরু করল, তখনই তার প্রভাব আমার ওপর পড়তে শুরু করে। বিশেষ করে ওই সময়ের নেতিবাচক মন্তব্য, ট্রোলিং এবং অপমান, যেগুলো ওই সময়ে আমাকে সহ্য করতে হয়েছে।’’

সেই সময়ে তাঁর পরিবার মানসিক ভাবে তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল বলে জানান চিমা। বলেন, “আমি দলকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই সময়ে কিছুই ঠিক চলছিল না। সে সময়ে আমার পরিবার আমার পাশে ছিল। তারা আমাকে যথেষ্ট উজ্জীবিত করে সেই দুঃসময়ে। ওরা চেয়েছিল, আমি যেন হাল না ছাড়ি। কিন্তু আমি মানসিক ভাবে এতটাই খারাপ অবস্থায় ছিলাম যে, ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করি। তখনই জামশেদপুর এফসি-র কাছ থেকে প্রস্তাবটা পাই।’’ জানুয়ারির দলবদলে জামশেদপুর এফসি তাদের ফরোয়ার্ড নেরিয়ূস ভালসকিসকে ছেড়ে দেয় এবং ড্যানিয়েল চিমাকে তাঁর জায়গায় সই করায়। এই চুক্তি ক্লাব ও চিমা দু’জনের পক্ষেই লাভজনক হয় বলে মনে করেন তিনি। চিমা বলেন, “জামশেদপুর এফসি-র মতো লিগ টেবলের ওপরের দিকে থাকা দলের প্রস্তাবটা পেয়ে আমি খুব উজ্জীবিত হয়ে উঠি। ভাবতেই পারিনি যে, আমার মতো একজন নীচের দিকে থাকা দলের স্ট্রাইকারকে ওরা নিতে চাইবে। আমার মনে হয়, আমার মধ্যে নিশ্চয়ই ওরা তেমন কোনও ভুল দেখেনি। দেখলে প্রস্তাব দিত না। তাই এই প্রস্তাবটা নিতে কোনও দ্বিধা করিনি।’’

জামশেদপুরে যোগ দিয়ে তিনি গোল করে দলকে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে জেতান। সেটিই ছিল ম্যাচের একমাত্র গোল। ৪৯ মিনিটের মাথায় সেটাই ছিল তাঁর দলের প্রথম গোলমুখী শট এবং তাতেই গোল করে দেন চিমা। সেই ম্যাচের পরে জামশেদপুরের কোচ আওয়েন কোইল চিমা সম্পর্কে বলেন, “কারা ওকে নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে আমি জানি না। কিন্তু আমার মতো যারা অনেক দিন ধরে ফুটবলে রয়েছে, তারা জানে চিমা একজন অসাধারণ খেলোয়াড়। যারা ওর দক্ষতা নিয়ে সন্দিহান, তারা হয়তো এসসি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ওর মাত্র দু’টো গোলের জন্য এ কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের সেই ম্যাচগুলোর দিকেও তাকানো উচিত। দলের পারফরম্যান্সে অবদান রাখতে গেলে যে গোল করতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। ড্যানিয়েল চিমা আমাদের দলে সেই কাজটাই করে, যাতে প্রমাণ হয় ওর মধ্যে যথেষ্ট গুণ রয়েছে। ও চ্যাম্পিয়ন। খুব ভালো মানুষও। আমাদের দলে যোগ দেওয়ার পর থেকে ও সবার সঙ্গে খুব ভাল ভাবে মিশে গিয়েছে।’’

আপাতত কোচের এই সমর্থন নিয়েই আইএসএলের বাকি অংশে নিজেকে প্রমাণ করতে চান। তিনি বলেন, “জামশেদপুর এফসি-তে সবাই যে ভাবে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, তাতে আমি অভিভূত। হোটেলে ওরা আমাকে বাড়ির পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টাও করেছে। ম্যানেজমেন্ট কর্তারা, কোচ সবাই আমাকে খুব উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে, সাহায্যও করছে।’’ তাহলে কি চিমা ওকোরির ফেলে যাওয়া ব্যাটন কাঁধে তোলার কাজটা জামশেদপুর থেকেই শুরু করলেন ড্যানিয়েল চিমা চুকুউ? বাংলার ফুটবলে কিন্তু এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে দিয়েছে এর মধ্যেই। বাংলায় ব্যর্থতার তকমা সেটে রন্টি মার্টিন্স-ওডাফা ওকেলিরাও একটা সময় রাজত্ব করেছেন ভারতীয় ফুটবলে। তাই ভবিষ্যতে চিমা কী করেন, সেটা দেখতে মুখিয়ে রয়েছে বাংলার ফুটবল মহল।