২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া হিংসার ঘটনায় (Bengal post-poll violence) বীরভূম জেলার এক ঘটনায় ফের চরম ভর্ৎসনা করল দেশের শীর্ষ আদালত। পাঁচজন তৃণমূল কর্মীর জামিন খারিজ করে বিচারপতি বিক্রম নাথ ও বিচারপতি সন্দীপ মেহতার বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়েছে—এই ঘটনা গণতন্ত্রের শিকড়ে আঘাত হানে। আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগও।
‘শুধু বিজেপি করতেন বলেই হামলা’ — সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ
আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ওই এলাকায় বিজেপি করার অপরাধেই আক্রান্ত হয়েছিলেন নির্দোষ মানুষ। আক্রান্তের স্ত্রীকে বিবস্ত্র করে হেনস্থা করা হয়েছিল, সেই অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। বরং থানার পুলিশ এফআইআর নেননি এবং আক্রান্ত পরিবারকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এই আচরণে পুলিশের নিরপেক্ষতা ও দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে শীর্ষ আদালত।
তৃণমূল কর্মীদের জামিন বাতিল, কাঠগড়ায় পুলিশ ও প্রশাসন
জানা গেছে, ২০২১ সালের ভোট-পরবর্তী হিংসার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচ তৃণমূল কর্মীকে সিবিআই গ্রেফতার করে ২০২২ সালে। পরে ২০২৩ সালের জানুয়ারি ও এপ্রিল মাসে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ থেকে জামিন পায় তারা। তবে চার্জশিট দাখিল হওয়ার পরও অভিযুক্তরা আদালতে হাজিরা দেয়নি। নিম্ন আদালতের নির্দেশ মানেনি তারা, এমনকি তদন্তেও অসহযোগিতা করে।
এই পরিস্থিতিতে সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায় হাইকোর্টের জামিনের রায় বাতিল করতে। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্ট এই গুরুত্বপূর্ণ রায় দেয়।
শীর্ষ আদালতের ভাষায়—গণতন্ত্রকে অপমান
বিচারপতিরা তাঁদের রায়ে বলেন, “এই হিংসা শুধু ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, এটা গণতন্ত্রের উপর আঘাত। শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে আক্রান্ত করা গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী।” অভিযুক্তদের প্রভাবশালী বলেও মন্তব্য করেছে আদালত। তদন্তে অসহযোগিতা ও হুমকির অভিযোগের কথাও স্বীকার করেছে শীর্ষ আদালত।
রাজ্যের প্রশাসনকে দায়বদ্ধ করার নির্দেশ
রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব এবং ডিজি-কে অবিলম্বে অভিযোগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি মামলা যাতে যথাযথভাবে এগোয়, তা দেখতে হবে রাজ্য প্রশাসনকেই। আদালত স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর এই ধরনের আক্রমণ বরদাস্ত করা হবে না।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পরেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। বিজেপি অভিযোগ তুলেছে, “এটাই প্রমাণ করে তৃণমূল সরকারের আমলে বিরোধী দল করার অপরাধেই মানুষকে আক্রমণ করা হয়েছে। পুলিশ ছিল নীরব দর্শক।” অন্যদিকে, তৃণমূলের মুখপাত্র পাল্টা বলেন, “আইন আইনের পথে চলবে। এখনও আদালতের রায় হাতে পাইনি। তা দেখে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
শীর্ষ আদালতের এই রায় শুধু পাঁচ অভিযুক্তের জামিন খারিজেই থেমে নেই। এটা রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতি এক বড় প্রশ্নচিহ্ন। পাশাপাশি এটা দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষার প্রশ্নে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা—যেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব কোনওভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।
সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণ এখন ভবিষ্যতের বিচারপ্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিক দায়িত্বে কতটা প্রভাব ফেলে, সে দিকেই নজর গোটা দেশের।