এক রাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন এই স্টেশন মাস্টার

বিশেষ প্রতিবেদন: কোনওদিন শুনেছেন সময় হবার আগেই একটা মেল ট্রেনকে স্টেশন থেকে জোর করে রওয়ানা করিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনবেন না। এমন কাজটি করিয়েছিলেন খোদ ডেপুটি…

station master saved the lives of thousands

বিশেষ প্রতিবেদন: কোনওদিন শুনেছেন সময় হবার আগেই একটা মেল ট্রেনকে স্টেশন থেকে জোর করে রওয়ানা করিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনবেন না। এমন কাজটি করিয়েছিলেন খোদ ডেপুটি স্টেশন সুপার। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই কাজ মারাত্মক ভুল কিন্তু এই কাজের জন্য রেল তাকে শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল, ভোপাল প্লাটফর্মে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা হয় তার নাম। তিনি গোলাম দস্তাগীর, সেন্ট্রাল রেলের এক পদস্থ কর্মচারী। তাঁর জন্যই বেঁচে গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের প্রাণ।

ঘটনা ১৯৮৪ সালের। ২ ডিসেম্বরের মাঝরাত , রোজকার মতন রাত দশটায় স্টেশনের ডিউটিতে এসেছিলেন গুলাম । জমে থাকা কিছু ফাইল দেখতে দেখতে কখন যে রাত একটা বেজে গেছে খেয়াল করেননি । প্লাটফর্মে গোরখপুর মুম্বই এক্সপ্রেস এসে দাঁড়াতে আড়ামোড়া ভেঙে অফিসের বাইরে এলেন । প্লাটফর্মে পা রাখতেই চোখ দুটো তার তীব্র জ্বালা করে উঠলো, গলা এমন শুকিয়ে গেল যেন দমবন্ধ হয়ে যাবে । তখনও উনি জানতে পারেননি স্টেশন মাস্টার সহ তেইশজন রেলকর্মী ইতিমধ্যেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে।

   

কিছু একটা ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটেছে আন্দাজ করে উনি সঙ্গে সঙ্গেই খবরটা জানালেন মধ্য রেলের কন্ট্রোল রুমে, দুদিকের বিদিশা আর ইটারসি স্টেশনে খবর দেন কোন ট্রেন যেন সেখান থেকে ছেড়ে এদিকে না আসে !

এবারে তার নজর গেলো এক্সপ্রেস ট্রেনটার দিকে । কেবিনে সিগন্যাল সবুজ করতে বলে ছুটে গেলেন ইঞ্জিনের দিকে । ড্রাইভার কে বললেন এখুনি ট্রেন ছাড়ার জন্য । বিস্মিত চালক যখন বললো ছাড়ার সময় আসতে এখনও পনেরো মিনিট বাকি, উনি দায়িত্ব নিয়ে লগবুকে লিখে দিলেন । হাজারের ওপর যাত্রী নিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে গেল এক্সপ্রেস ট্রেনটি । বেঁচে গেল সেই ট্রেন সহ আরও কয়েকটি ট্রেনের যাত্রীদের প্রাণ।

পঁয়ত্রিশ বছর আগে সেই রাতেই ভূপালের ‘Union Carbide’ কারখানার স্টোরেজ ট্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এসেছিল প্রায় ৩০ টন বিষাক্ত ‘methyl isocyanate’ বা মিক গ্যাস। যার প্রভাবে সেরাতে ছয়লক্ষ মানুষের স্বাভাবিক জীবনটাই গেলো বদলে । হাজার হাজার মানুষ যারা মারা গেলো সেদিন তারা তো একদিক দিয়ে বেঁচে গেলো, বাকিরা কেউ বিকলাঙ্গ কেউ অন্ধ কেউ ভয়ঙ্কর ফুসফুস বা চর্মরোগ নিয়ে দগ্ধে দগ্ধে বেঁচে ছিল বাকি জীবন।
ট্রেনটা ছেড়ে যাবার পরও সেরাতে তার বউ বাচ্চার হাল দেখতে কোয়ার্টারে ফিরে যাননি গোলাম দস্তাগীর। চারিদিকে ফোন করে ডাক্তার ও এম্বুলেন্স আনিয়েছেন বিষাক্ত গ্যাসের ছোবলে যারা প্লাটফর্মে ছটফট করছিল তাদের জন্য । সারারাত নাকে রুমাল বেঁধে আচ্ছন্ন সহকর্মীদের হাসপাতালে পাঠিয়েছেন, যোগাযোগ রেখেছেন আশেপাশের সব স্টেশনের সঙ্গে।

রাত কেটে সকাল হয়, মনে পড়ে পরিবারের কথা। ক্লান্ত আচ্ছন্ন গুলাম দস্তাগীর কোনক্রমে শরীরটা টানতে টানতে পৌঁছান রেল কোয়ার্টারে । গ্যাসের ছোবল ততক্ষণে কেড়ে নিয়েছে তার এক পুত্রকে, আরেকজনের সারা শরীরে ছড়িয়েছে সংক্রমণ । সারারাত গ্যাসের প্রত্যক্ষ স্পর্শে থাকার দরুন গোলাম সাহেবেরও শ্বাসনালী হয়েছিল ভীষন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত । বাকি জীবনটা তাঁকে বাড়ি আর হাসপাতাল করেই কাটাতে হয়েছিল । ২০০৩ সালে দুনিয়া থেকে কিছুটা অভিমান নিয়েই বিদায় নেন এই মানুষটি ।

মৃত্যুর কারণ হিসাবে সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছিল “suffering from diseases caused as a direct result of exposure to MIC (Methyl Isocyanate) gas.”