বিশ্বাসঘাতককে হত্যা করে ক্ষুদিরামদের ফাঁসির বদলা নিয়েছিল এই বাঙালি

বিশেষ প্রতিবেদন: এই বাংলার মাটিতে অনেক বীর দামাল ছেলেরা জন্ম নিয়েছেন। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য নিজের জীবনকে মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচন এর জন্য বলিদান দিয়েছিল। তাদের…

Satyendranath Bosu

বিশেষ প্রতিবেদন: এই বাংলার মাটিতে অনেক বীর দামাল ছেলেরা জন্ম নিয়েছেন। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য নিজের জীবনকে মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচন এর জন্য বলিদান দিয়েছিল। তাদের মধ্যে সেই মহান বিপ্লবী আর কেউ নন তিনি হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

ইনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন অন্যতম অগ্নিযুগের বিপ্লবী শহীদ। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্ম হয় ৩০ শে জুলাই ১৮৮২ সালের মেদিনীপুর জেলায়। সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন মনিষী রাজনারায়ণ বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র। তার পিতার নাম অভয়চরণ বসু।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু তার জ্যেষ্ঠতাত ছিলেন রাজনারায়ণ বসু ও অগ্রজ জ্ঞানেন্দ্রনাথ। সত্যেন্দ্রনাথ এন্ট্রাস পাশ করেন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৮৯৭ সালে। ১৮৯৯ সালে এফ এ পাশ করেন মেদিনীপুর কলেজ থেকে। বি.এ পড়ার জন্য কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হন, কোন এক কারনে পরীক্ষা দিতে পারেনি। তার অগ্রজ জ্ঞানেন্দ্রনাথ এবং রাজনারায়ণ বসুর প্রভাবে মেদিনীপুরে ১৯০২ সালে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠেছিলো। সেই সংগঠনের নেতা ছিলেন হেমচন্দ্র দাস কানুনগো এবং সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন তার সহকারী।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় “ছাত্রভাণ্ডার” গড়ে তোলেন। সেখানেই তাঁত, ব্যায়ামচর্চা ইত্যাদির আড়ালে বিপ্লবীদের ঘাঁটি তৈরি হয়। ক্ষুদিরাম তারই নির্দেশে “সোনার বাংলা” শীর্ষক বিপ্লবাত্মক ইশতেহার বিলি করে ধরা পড়েন। পরে আলিপুর বোমা মামলা জড়িত থাকায় গ্রেপ্তার করা হয় সত্যেন্দ্রনাথকে। বিচারে নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হলে তাকে মারার পরিকল্পনা করেন বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সত্যেন্দ্রনাথ বসু বুদ্ধি করে নরেন গোঁসাইকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে ও নরেন গোঁসাইকে গোপনে খবর দেয় আমি রাজসাক্ষী হতে রাজি। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিবৃতি দেবেন। নরেন খবরটা অপরওয়ালা পুলিস কতৃপক্ষের কাছে জানিয়ে ছিলেন ও তারা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর এই আর্জিকে মঞ্জুর করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেনের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললেন। নরেনের উৎসাহের শেষ নাই। শেষ অব্দি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো বিপ্লবী যদি রাজসাক্ষী হয় তাহলে আর ভাবনা কিসের। সত্যেন্দ্রনাথ বসু এই দিনটির প্রতিক্ষাতেই ছিলেন। কানাইয়ের সঙ্গে শেষ মুহূর্তের পরামর্শ করে নিলেন। ডিসপেনসারির মধ্যেই এই কাজটা করতে হবে। ঠিক হলো কলাইলাল দত্ত সেখানে পৌঁছে যাবেন দাঁত মাজার অছিলায়। সশস্ত্র অবস্থায় থাকবেন। যথা সময়ে অপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। নরেনকে দেখে কানাইলাল বারান্দায় চলে গেলেন। কান সজাগ রাখলেন ঘরের ভিতর। ঘরের ভিতর কথা হচ্ছে, ঠিক তখনই সত্যেন্দ্রনাথ বসু নরেনকে গুলি চালায়। গুলিটি লাগলো উরুতে গুলিবিদ্ধ, নরেন গোঁসাই আর্তনাদ করে ঘর থেকে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে ধরার জন্য হিগিনস ছুটে এলেন, সত্যেন্দ্রনাথ এর গুলি এসে হিগিনসকে বিদ্ধ করলো। এই হিগিনস হচ্ছেন নরেন গোঁসাই এর গার্ড। এতে নরেন পালাতে চেষ্টা করে, দেখে ফেলেন কানাইলাল দত্ত তার পশ্চাৎধাবন করলেন। হাসপাতালের গেট পার হয়ে নরেনের কাছাকাছি পৌঁছে কানাইলাল গুলি করতে শুরু করেন। গুলি খেয়ে নরেন স্নানঘরের পাশে নর্দমার মধ্যে হামাগুড়ি খেয়ে পরে গেলেন। আরো এক নরেনের দেহরক্ষী লিন্টন কানাইলালকে ধরতে যান, কানাইলালের গুলিতে লিন্টনের কপালের চামড়া ঝরে যায়। সত্যেন্দ্রনাথ এগিয়ে এলেন, দুজনে শেষ গুলিটি অব্দি নরেনের ওপর বর্ষণ করেন। সব মিলিয়ে তারা ৯টি গুলি চালান। জেলের পাগলা ঘুন্টি বেজে উঠল, সশস্ত্র পুলিস বাহিনী এগিয়ে আসেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও কানাইলাল দত্ত কে বন্দি করেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও তার বন্ধু কানাইলাল দত্তের বিচারের পালা। বিচারে তাদের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১০ ই নভেম্বর ফাঁসি হলো কানাইলাল দত্তের। আর বাকি রইল ২২ শে নভেম্বর সত্যেন্দ্রনাথ বসুর দিন। ফাঁসির কয়েক দিন আগে হেমচন্দ্র কানুনগোকে জেলের গরাদের ও পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু,—- “মা যদি এখানে এসে না কাঁদেন, তবেই আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি, নচেৎ নয়।” তা-ই হল। আলিপুর জেলে মা ও ছেলে মুখোমুখি। বুকের কান্না চোখের জলে ধুয়ে যাওয়ার সুযোগ পেল না।

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রেসিডেন্সি জেলে ১৯০৮ সালের ২২ শে নভেম্বর ফাঁসি হয়ে গেল। ফাঁসির পর সত্যেন্দ্রনাথের শবদেহ জেলের বাইরে এল না। জেলখানার উঁচু পাঁচিলের ঘেরাটোপের মধ্যে দাহ করা হয়। এমনকি হেমচন্দ্র কানুনগোরা কোনও স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত সঙ্গে নিতে পারেননি। সত্যিই এতবড়ো বলিদান, আজকের প্রজন্ম কি তা জানে, না জানে না। এভাবেই বাংলার একের পর এক দামাল ছেলেরা মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য বলিপ্রাপ্ত হয়েছিল।