জাদু কি ঝাপ্পি বাঁচিয়ে দিয়েছিল দুই বোনকে

Special Correspondent, Kolkata: ডাক্তার নয়, সেদিন শিশুটির জীবন বাঁচাতে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নার্স কাসপারিয়ান। মৃত প্রায় বোনকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল, একই ইনকিউবেটরে থাকা ছোট যমজ দিদির…

rescue hug

Special Correspondent, Kolkata: ডাক্তার নয়, সেদিন শিশুটির জীবন বাঁচাতে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নার্স কাসপারিয়ান। মৃত প্রায় বোনকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল, একই ইনকিউবেটরে থাকা ছোট যমজ দিদির এক আলিঙ্গন, ‘ডাবলবেডিং-পদ্ধতির’ মান্যতাকে মেনে।

ম্যাসাচুসেটসের জ্যাকসন দম্পতির মনে আনন্দের সীমা ছিল না। বিয়ের প্রায় সাত বছর পর সন্তান আসতে চলেছিল তাঁদের জীবনে। তাও আবার যমজ। স্ত্রী হেইডিকে দেখাশুনা করার জন্য নিজের ব্যবসা প্রায় লাটে তুলতে বসেছিলেন স্বামী পল জ্যাকসন। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরের শেষে হেইডির প্রসব হওয়ার কথা ছিল।

প্রভু যিশুর দেওয়া উপহার, নিউইয়ার্স ইভে বরণ করে নেওয়ার জন্য মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত হচ্ছিলেন জ্যাকসন দম্পতি। কিন্তু সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল চিকিৎসকদের রায়ে। তাঁরা জানিয়েছিলেন গর্ভস্থ শিশুদুটির বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনক। সময়ের আগেই সিজার করতে হবে। না হলে শিশুদুটিকে বাঁচানো যাবে না।

নির্দিষ্ট তারিখের প্রায় বারো সপ্তাহ আগে, ১৭ অক্টোবর, সিজার করতে বাধ্য হয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। পৃথিবীর আলো দেখেছিল দুই অপুষ্ট কন্যা সন্তান কাইরি ও ব্রিয়েল। ব্রিয়েল তার দিদি কাইরির চেয়ে মিনিট কয়েকের ছোট। জন্মাবার পরে তাদের রাখা হয়েছিল হাসপাতালের ‘নিওনাটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট’-এর ইনকিউবেটারে। ভীষণ কম ওজন ছিল দুই বোনের। বড় বোন কাইরির ওজন ছিল ৯৯২ গ্রাম এবং ব্রিয়েলের ৯০৭ গ্রাম।

ইনকিউবেটরের মধ্যে দ্রুত বাড়তে শুরু করেছিল কাইরির ওজন। কিন্তু অন্য ইনকিউবেটরে থাকা ব্রিয়েল ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিল তার জীবনীশক্তি। শুরু হয়েছিল শ্বাসকষ্ট। ঠান্ডা এবং নীল হয়ে আসছিল ব্রিয়েলের ছোট্ট শরীর। একই সঙ্গে দেখা দিয়েছিল হৃদপিন্ডের সমস্যা। ওজনের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অক্সিজেন দেওয়া সত্বেও ব্রিয়েলের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাচ্ছিল। ব্রিয়েলের বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। অন্যদিকে নিজের ইনকিউবেটরে হাত পা ছুঁড়ছিল ব্রিয়েলের সুস্থ্য সবল দিদি কাইরি।

ব্রিয়েলের শারীরিক অবস্থার চুড়ান্ত অবনতি ঘটেছিল নভেম্বরের ১২ তারিখে। একটু বাতাসের জন্য লড়াই করছিল ব্রিয়েল। তার মুখ, সরু সরু হাত পা কালচে নীল হতে শুরু করেছিল। হার্টবিট ভয়ঙ্কর কমে গিয়েছিল। হেঁচকি তুলতে শুরু করেছিল ব্রিয়েল। হাসপাতাল থেকে ফোন পেয়ে স্বামীকে নিয়ে ছুটে এসেছিলেন, সদ্য ঘরে ফেরা হেইডি জ্যাকসন। ব্রিয়েলের সময় ফুরিয়ে আসছে জেনে হাতের পাতায় মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তাঁরা।

ব্রিয়েলের দেখাশুনার দায়িত্বে ছিলেন হাসপাতালের অভিজ্ঞ নার্স গেইল কাসপারিয়ান। সিস্টার কাসপারিয়ান দিনরাত এক করে ব্রিয়েলকে বাঁচানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রচলিত সমস্ত চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে ব্রিয়েলকে জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন চিকিৎসকেরাও। তবুও ব্রিয়েল শ্বাস নিতে পারছিল না। হার্টবিট ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিল।

হঠাৎ সিস্টার কাসপারিয়ানের মনে পড়ে গিয়েছিল, এক বয়স্কা সিস্টারের বহুদিন আগে বলা ‘ডাবল-বেডিং’-এর কথা। সদ্যজাত বা সময়ের অনেক আগে জন্ম নেওয়া অপুষ্ট যমজ শিশুদের একই ইনকিউবেটরে রাখার একটি পদ্ধতি হল ‘ডাবল-বেডিং’। যেটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত হলেও, সংক্রমণের ভয়ে আমেরিকায় এই পদ্ধতির প্রচলন ছিল না।

ইউমাস হাসপাতালের চিফ নার্স সুজান ফিটব্যাক সেই সময় একটি কনফারেন্সে গিয়েছিলেন। চিকিৎসকেরাও তখন ওয়ার্ডে ছিলেন না। শিশুটির জীবন বাঁচাতে এক অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সিস্টার কাসপারিয়ান। প্রথা ভাঙার জন্য চাকরি চলে যেতে পারে জেনেও ইনকিউবেটর থেকে বের করে নিয়েছিলেন মরতে বসা ব্রিয়েলকে।

জ্যাকসন দম্পতিকে বলেছিলেন,”আমাকে একবার শেষ চেষ্টা করতে দিন, আমি ব্রিয়েলকে তার দিদির পাশে রাখতে চাই।” সিস্টার কাসপারিয়ানের কোলে থাকা ব্রিয়েলের শরীরে খিঁচুনি এসে গিয়েছিল। ব্রিয়েলের বাবা মা বুঝতে পারছিলেন আর হয়ত কয়েক মিনিট, তারপর ছোট্ট ব্রিয়েলের সব লড়াই শেষ হয়ে যাবে। বিদ্ধস্ত জ্যাকসন দম্পতি সম্মতি জানিয়েছিলেন।

সিস্টার কাসপারিয়ান দ্রুত দিদি কাইরির ইনকিউবেটরের ঢাকনা খুলে কাইরির বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলেন বোন ব্রিয়েলকে। ১৭ অক্টোবর জন্ম নেওয়ার ২৭ দিন পর দুই বোন কাছাকাছি এসেছিল। ঠিক তখনই ঘটে গিয়েছিল ‘মিরাকল’। অবাক চোখে সিস্টার কাসপারিয়ান ও জ্যাকসন দম্পতিকে দেখেছিলেন, ইনকিউবেটরের ঢাকনা বন্ধ করার আগেই ব্রিয়েল গড়িয়ে দিদির গা ঘেঁষে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়েছিল। দিদির গায়ে গা ঠেকিয়ে শোয়ামাত্রই ব্রিয়েলের খিঁচুনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে বেড়ে গিয়েছিল ব্রিয়েলের শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা। যা জন্মের পর থেকে ব্রিয়েলের শরীরে দেখা যায়নি।

দিদি কাইরি অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। বোন আসার পর নিজে থেকেই হঠাৎ সে জেগে উঠেছিল। সবাইকে অবাক করে কাইরি তার ছোট্ট বাম হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল মৃতপ্রায় বোনকে। চোখে জল এসে গিয়েছিল সিস্টার কাসপারিয়ানেরও। দিদির আলিঙ্গনে ক্রমশ জীবনে ফিরে আসছিল ব্রিয়েল। বাড়তে শুরু করেছিল শরীরের উষ্ণতা। জন্মের পর সেই প্রথম ঠিকভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে শুরু করেছিল ব্রিয়েল। ত্বকের রঙ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। সেই সময়ে হাসপাতালের ছবি তুলতে এসেছিলেন এক চিত্র-সাংবাদিক। নিওনাটাল বিভাগে ‘মিরাকল’ ঘটেছে, খবরটি পেয়ে ছুটে এসেছিলেন ক্যামেরা নিয়ে। তুলে নিয়েছিলেন ঐতিহাসিক দৃশ্যটি।

কাকতালীয়ভাবে সেদিন চিফ নার্স সুজান ফিটজ্যাক, কনফারেন্সে যমজ অপুষ্ট শিশুদের ‘ডাবল-বেডিং’ নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘ডাবল-বেডিং’ পদ্ধতির প্রচলন হওয়া উচিত আমেরিকায়। তিনি জানতেনও না তাঁর হাসপাতালেই ‘ডাবল-বেডিং’ মিরাকল ঘটিয়ে দিয়েছে। হাসপাতালে ফিরে খবরটি পেয়ে আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলেন সুজান। কনফারেন্সে যাওয়ার সময় নিশ্চিত ছিলেন, ফিরে এসে শুনবেন ব্রিয়েল নেই। দুঃসাহসী ও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য জড়িয়ে ধরেছিলেন সিস্টার কাসপারিয়ানকে।

দিদির কাছে দেওয়ার পর, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে উঠেছিল ব্রিয়েল। দ্রুত বাড়ছিল ওজন, পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল ব্রিয়েলের দুষ্টুমি। সারাক্ষণ দুইবোনে খুনশুটি করত ইনকিউবেটরে। দুজনের মুখেই ফুটে উঠত স্বর্গীয় হাসি। যার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা হাসপাতালে। কয়েক মাস পরে, হাসপাতাল থেকে বাবা মায়ের সঙ্গে বাড়ি গিয়েছিল দুই বোন। সিস্টার কাসপারিয়ানের নির্দেশে বাড়িতেও কাইরি আর ব্রিয়েলকে রাখা হয়েছিল এক বিছানায়।

চিত্র-সাংবাদিকের তোলা ‘The Rescue Hug’ ছবিটি ছাপা হয়েছিল বিশ্বের প্রায় সবকটি বড় সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে। অন্যদিকে বিপদের মুহুর্তে মরিয়া হয়ে ওঠা সিস্টার কাসপারিয়ানের সিদ্ধান্ত তৈরি করেছিল ইতিহাস। আমেরিকায় সেই প্রথম প্রথা ভেঙে একই ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছিল দুই সদ্যজাত যমজ শিশুকে। যা পরে চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে মেনে নিয়েছিল আমেরিকা।

কেটে গিয়েছে ২৫ বছর। অভিন্ন হৃদয় কাইরি আর ব্রিয়েল আজ যুবতী। আজও সিস্টার কাসপারিয়ানের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ আছে। মাঝে মাঝে দেখা করেন তাঁরা তিনজন। সেই সিস্টার কাসপারিয়ান, যাঁর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বাঁচিয়ে দিয়েছিল একটি জীবন। পালটে দিয়েছিল আমেরিকার চিকিৎসা ব্যবস্থা। প্রমান করেছিল একটি মাত্র আলিঙ্গন কাউকে জীবনে ফেরানোর ক্ষমতা রাখে।