বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে মহামারীর দুঃস্বপ্নের স্মৃতিস্তম্ভরা

বিশেষ প্রতিবেদন: বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব চলেছে। যুগে যুগে কলেরা ইয়োলো ফিভার প্লেগ স্প্যানিশ ফ্লু প্রভৃতি নানা ধরণের এই বিশ্বব্যাপি মহামারীর আক্রমণে কত নগর সভ্যতা…

memorials of pandemics

বিশেষ প্রতিবেদন: বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব চলেছে। যুগে যুগে কলেরা ইয়োলো ফিভার প্লেগ স্প্যানিশ ফ্লু প্রভৃতি নানা ধরণের এই বিশ্বব্যাপি মহামারীর আক্রমণে কত নগর সভ্যতা জনপদ ধ্বংস হয়ে গেছে । পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ অসহায়ের মত মহামারীর কাছে আত্মবিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছে । কখনও সেটা ঘটেছে মহামারীর কার্যকারণ সম্পর্ক না জানায় , কখনো বা উপযুক্ত বা পর্যাপ্ত প্রতিষেধক না থাকায় ,কখনও বা শাসকের অবহেলায় ।

কারণ যাই হোক না কেন তার শেষ ফলভোগ করতে হয়েছে সাধারণ নিরীহ মানুষজনকে লাখে লাখে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে । কালের নিয়মে এক সময়ে আপনা হতেই পৃথিবী থেকে ঐসব মহামারী মরণ কামড় দিয়ে বিদায় নিয়েছে । পিছনে রেখে গেছে তার ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। পরবর্তীকালের মানুষ মহামারীর সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলির কথা স্মরণ করে পৃথিবীর নানা স্থানে ওই সব ভয়াল মহামারীর স্মারকস্তম্ভ তৈরী করেছে । প্রার্থনা করেছে এমন দিন যেন আর না আসে ।

চারমিনার কলেরা মহামারীর স্মৃতিতে তেমন প্রার্থনাই করেছিলেন ষোড়শ শতকে কুতব শাহি নবাববংশের পঞ্চম নবাব মোহম্মদ কুলি কুতব শাহি , হায়দরাবাদ সহরকে ভয়াবহ কলেরা মহামারীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য । হায়দরাবাদ তখন ভয়াবহ কলেরা মহামারীর প্রকোপে লোক মরে উজাড় হয়ে জনপদ বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছিল । মহামারী থেমে গেলে মোহম্মদ কুলি সেই মহামারীর স্মৃতিতে মুসি নদির পূর্ব তীরে ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে নির্মান করলেন বিশ্ববিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ “চারমিনার” – যাকে ছাড়া হায়দরাবাদের ছবি চিন্তাই করা যায় না । চারমিনারের পাশেই সেই জায়গায় গড়ে তুললেন বিখ্যাত মসজিদ যেখানে তিনি মহামারী থেকে হায়দরাবাদ সহরকে বাঁচাবার জন্য আল্লার কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন । পার্সিয়ান গ্রন্থে অবশ্য হিজরি সালের দ্বিতীয় শতাব্দী শুরু হবার সন্ধিক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য চারমিনার নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে ।

কলেরা রায়ট
কলেরা মহামারীকে কেন্দ্র করে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে “সেন্ট পিটার্সবার্গের কলেরা রায়ট” রাশিয়ার ইতিহাসের এক ঘৃণ্য অধ্যায় । সেন্ট পিটার্সবার্গে স্থাপিত জার প্রথম নিকোলাস স্মারকস্তম্ভের প্রস্তরফলকের ভাস্কর্যের ছবিতে উৎকীর্ণ রয়েছে: ঘোড়ার গাড়িতে জার নিকোলাস দাঁড়িয়ে কলেরা দাঙ্গায় জড়িত প্রজাদের হাঁটু গেড়ে বসে টুপি খুলে রাখতে আদেশ করছেন ।

এবার ফিরে যাই সেই রাশিয়ার কলেরা দাঙ্গার আগের সময়টায় । কলেরা যে জলবাহিত অসূখ – এই ধারণাটা তখন ছিল না । সহরের নর্দমার দূষিত জল গিয়ে পড়ছে নদিতে ।জল দূষিত হচ্ছে । সেই দূষিত নেভা নদির জল খেয়ে রাশিয়ায় ব্যাপক কলেরা সংক্রমণ হয় ,প্রচুর লোক মরতে থাকে । সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন এলাকায় কোয়ারেন্টাইন করে দেওয়া হল । কিন্তু বিশেষ অঞ্চলকে ঘিরে কর্ডন করাকে সাধারণ মানুষের মনে হয়েছিল সাধারন মানুষদের আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে শুধু বড়লোকদের বাঁচাবার জন্যে ।ফলে সাধারণ মানুষেরা মারা যাচ্ছে ।দলে দলে কলেরা রোগী মারা যাওয়ায় সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের ক্ষোভ বাড়ছিল ।

১৮৩৩ সালের ২২শে জুন সেন্ট পিটার্সবার্গের সেন্নায়া স্কোয়ারে রাশিয়ার সাধারণ মানুষজন কলেরা রোগ প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না কেন – এই নিয়ে সরকার বিরোধী জমায়েত করে বিক্ষোভ দেখায় । পরে জনতা মারমুখি চেহারা নিয়ে সহরের প্রধান কলেরা হাসপাতাল ভেঙ্গে ধূলিস্যাত করে দেয় , বাজারের স্যানিটারি ইনস্পেক্টরকে মারধোর করে ,এবং ডাক্তাররা খাবার জলের কুয়োয় বিষ মিশিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ তুলে তাদের মেরে ফেলে । সৈন্য নামিয়েও এই কলেরা মহামারীদাঙ্গা থামান যায় না । তখন জার প্রথম নিকোলাস সেখানে পৌঁছে প্রজাদের টুপি খুলে হাঁটু গেড়ে বসতে আদেশ করেন । প্রজারা সেই আদেশ পালন করে । জনতা শান্ত হয় । দাঙ্গা থেমে যায় । যদিও কলেরা মহামারী থামে না । সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রথম নিকোলাসের মুর্তির কাছে এই ইতিহাসের অংশ খোদাই করা রয়েছে ।

ইংল্যান্ডের শেফিল্ডে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের কলেরা মহামারী স্মরণে এক “কলেরা মনুমেন্ট” নামে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়েছিল যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন কবি জেমস মন্টাগোমারি । ৪০২ জন কলেরা আক্রান্তের মধ্যে ৩৩৯ জনের মৃত্যু হলে তাদের পার্ক হিল এবং ক্লে উডের নরফলক পার্কের মধ্যবর্তী অঞ্চলে সমাধিস্থ করা হয় । এই স্মারক স্তম্ভ নির্মাণ করার জন্য বোর্ড অফ হেলথ অর্থ বরাদ্দ করেছিল । এম ই হ্যাডফিল্ড এর প্ল্যান অনুযায়ী স্থপতি ইয়ার্প এবং হবস নিও গথিক পিনাকল স্থাপত্যের গির্জার আকারের এই কলেরা মনুমেন্ট এর কাজ শেষ করেন ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ।

প্লেগ মহামারীর স্মৃতিস্তম্ভ: ভিয়েনায় প্লেগের স্মারক স্থাপিত হয় ১৬৭৯ -৮০ খ্রিস্টাব্দের “ দি গ্রেট প্লেগ অফ ভিয়েনা ” স্মরণে । এই ভয়ংকর প্লেগের সংক্রমণে অস্টিয়ার ভিয়েনা সহরে ৭৬০০০ মানুষের মৃত্যু হয় । ৬৯ ফুট স্মৃতিফলক সম্বলিত ভিয়েনার প্লেগ স্মারকটির নাম BAROQUE KARISKIRCHE প্লেগ মহামারী নিয়ে আর একটি স্মৃতিস্থম্ভ হল “হোলি ট্রিনিটি কলাম ”। ১৫ মিটার লম্বা এই কলাম টি স্থাপিত হয়েছে বুডা’স ক্যাসল জেলার ট্রিনিটি স্কোয়ারে । ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে বুডা কাউন্সিল প্লেগ মহামারী থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা এবং ঈশ্বরের কৃপায় প্লেগ মহামারী থেমে যাওয়ায় প্লেগের স্মৃতিস্থম্ভ তৈরীর সিদ্ধান্ত গ্রহন করে । ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে এই স্মারকের ভিত্তি স্থাপন হয় .১৭০৬ সালে এর কাজ শেষ হয় । কিন্তু ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে এই হোলি ট্রিনিটি কলাম টি তুলে নিয়ে গিয়ে উজলাক নামক স্থানে প্রতিস্থাপন করা হয় । পরিবর্তে এই ট্রিনিটি স্কোয়ারে আর একটি বড় সুসজ্জিত নতুন হোলি ট্রিনিটি কলাম স্থাপন করা হয় ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই জুন ।

স্প্যানিশ ফ্লু স্মারক স্তম্ভ:  ফ্লু মহামারী স্মারকটি রয়েছে ক্যানসাস সিটির ফোর্ট রিলে’র ক্যাম্প ফানসটনের ইঞ্জিনিয়ার্স ক্যানাইওন এ । সৈন্য পরিবহনের ট্রেনে স্যানিটারি কাজে নিযুক্ত দশজন সৈন্যের ফ্লু তে অকালমৃত্যুর ঘটনার স্মরণে পিরামিডের আকৃতির এই স্মারক স্তম্ভটি হ্যারী হার্ডির নকশায় ১৯১৮ – ২০ তে নির্মিত হয় ।
ক্যাম্প মেরিট মেমোরিয়াল মনুমেন্ট স্থাপিত হয়েছে প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধে স্পানিশ ফ্লুতে মৃত ১৫ জন আমেরিকান সেনা বাহিনীর অফিসার ,৫৫৮ জন সৈন্য , ৪ জন নার্স এবং ১ জন সিভিলিয়ানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। নিউ জার্সির ক্রেস্কিল ও ডূমন্ট সীমান্ত এলাকায় এই ক্যাম্প মেরিট ছিল ইউরোপে যুদ্ধ করতে যাওয়া সৈনিকদের সবচেয়ে বড় ট্রানজিট বেস ক্যাম্প । ১৯১৮ সালের দু মাস ব্যাপী স্পানিশ ফ্লু সংক্রমনে এই ক্যাম্পের ৫৭৮ জন মারা যায় । তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এখনে ৬৬ ফুটের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী স্মৃতি স্তম্ভ স্থাপন করা হয় ।

 

ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর স্মারকস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে নিউজিল্যান্ড সরকারের বদান্যতায় সামোয়া নামক স্থানে। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে সামোয়ায় স্পানিশ ফ্লু’র সংক্রমণে ৮৫০০ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে । তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এই মহামারী স্মৃতিস্থম্ভ নির্মাণ করা হয় ।

“WAITAPU URUPA INFLUENJA MEMORIYAL” নামে আর একটি স্পানিশ ফ্লু মহামারী স্মারক নির্মান করা হয়েছে নিউ প্লিমাউথ এনগামটু বিচের কাছে ওয়াইটাপু উড়ুপার সমাধি জমিতে । ১৯১৮-১৯ সালে তারাঙ্কি সহরে স্পানিশ ফ্লু তে মৃত অজ্ঞাত নামা মানুষদের জন্য এই স্মারকটি উড়ূপায় কর্মরত এক রাজ মিস্ত্রী ক্যাল্লাম মাহির ব্যাক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত হয় হতভাগ্যদের মৃত্যুর একশ বছর পরে ২০১৮ সালের ১০ ই নভেম্বর । স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ আছে – “ In remembrance of those soules lost forever . The resting place of unknown loved ones who died from Great Flu Epidemic in Taranki ”

ইয়োলো ফিভার স্মারক: ইয়োলো ফিভার নামক রোগটি মহামারী রুপে ছড়িয়ে পরে বহু মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছিল । ইয়োলো ফিভার সংক্রমণের ইতিহাস চমকপ্রদ । ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ ই জুন ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ‘দি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন’ নামক একটি জাহাজ খারাপ হয়ে যাওয়ায় ভার্জিনিয়ার নরফলক বন্দরে রিপেয়ার কাজ করানোর জন্য ভিড়ে নোঙ্গর করে রইল । এই জাহাজে ইয়োলো ফিভারের জীবাণু বাহী কয়েকটি মশা ছিল ,যেগুলি জাহাজ ছেড়ে নরফলক বন্দরসহরে্র মানুষদের কামড়ে মাধ্যমে দ্রুত ইয়োলো ফিভার ছড়িয়ে দিয়ে এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু ঘটাল । সহরের তরূণ মেয়রও এই অসুখে প্রাণ হারালেন । প্রতিদিন শয়ে শয়ে লোক মরতে থাকায় গণকবর খুঁড়ে তাদের মাটি চাপা দিতে হচ্ছিল । পরবর্তী কালে এই কবরখানায় তৈরি হয় “ইয়োলো ফিভার পার্ক” ।

টেনেসি ভ্যালির মেমফিস এ গড়ে উঠেছে “ইয়োলো ফিভার মার্টার মেমোরিয়াল”। . ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে মেমফিস সহরে ইয়োলো ফিভার মহামারীতে ৫১৫০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে । উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে এই সহরের এক কবরখানায় দেড় হাজার মানুষের গণকবর দিতে হয় । পরবর্তী কালে এই জায়গা পরিত্যক্ত হয় । কিন্তু ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩ রা জানুয়ারি এখানে মিসিসিপি নদির ধারের অনুচ্চ টিলায় শহিদ পার্ক গড়ে ওঠে । পার্কের মধ্যস্থলের ফলকে লেখা আছে: “The Heros and Heroins of Memphis Who gave their Lives Serving the Victims of Yellow Fiver .”

১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ইয়োলো ফিভার এপিডেমিকের স্মরণে বুয়েন্স এয়ার্সের পার্ক ফ্লোরেন্টিনা আমেঘিনো ( Parque Florentina Ameghino )অঞ্চলে ইয়োলো ফিভার মনুমেন্ট নির্মিত হয়েছিল ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে । বুএনস এয়ার্সে ১৮৫২ , ১৮৫৮ , ১৮৭০ , ও ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ইয়োলো ফিভার মহামারী ভয়ংকর ভাবে প্রাণহানি ঘটিয়ে ছিল ।

মহামারী বিরুদ্ধে সৈনিকদের উদ্দেশ্যে স্মৃতিস্তম্ভ
মহামারি স্মারক স্তম্ভের বর্ণনার উপসংহারে পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়ার ইয়োলো ফিভারের এক স্মৃতিস্তম্ভের কথা বোলব যেটি দেখতে অবিকল আমাদের কলকাতার মনুমেন্টের মত । ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই ইয়োলো ফিভার মনুমেন্টটি উৎসর্গ করা হয়েছে মহামারী যোদ্ধা ডাক্তার ,নার্স , ও ওষুধ সরবরাহকারি যারা ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ভার্জিনিয়ায় ইয়োলোফিভার রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে সেখানেই মহামারীর করাল গ্রাসে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে । মহামারীর দুঃস্বপ্নের মধ্যে এই্সব স্মারক স্তম্ভের স্মৃতিফলকগুলি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে । মানুষ আজো কত অসহায় ভয়াল প্রকৃতির খেয়ালী আচরণের কাছে।