অফবিট ডেস্ক: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ভারতবর্ষের বুকে জন্ম নেওয়া এক ক্ষনজন্মা পুরুষ। সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। বিদ্যাসাগর উপাধির সঙ্গে শুধু পুস্তকগত শিক্ষাই নয়, জড়িয়ে রয়েছে সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর অগাধ পান্ডিত্যও। বর্তমান সময়ের অন্যতম বিষয়, ‘নারী-শিক্ষা’ এবং ‘নারী-স্বাধীনতা’র মানসিক দ্বারোদঘাটন হয়েছিল যাদের হাত ধরে, তাদের মধ্যেই প্রথমেই আসে তাঁর নাম। তাঁর জীবন জোড়া অপরিসীম মানব দরদ, দক্ষ পরিচালনায় সমাজ সংস্কার। বাঙালির ‘বর্নপরিচয়’-এর স্রষ্টার এই দিকগুলি সম্পর্কে বাঙালি যতটা অবগত, তাঁর জীবনের আরেকটি দিক সম্পর্কে সাধারন মানুষ ততটাই অন্ধকারে।
আরও পড়ুন কালের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস
বিদ্যাসাগরের সেই পরিচয়টির আক্ষরিক নাম ‘চিকিৎসক’। শেষজীবনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ডিগ্রীবিহীন স্বশিক্ষিত চিকিৎসক। সমাজের অনগ্রসর সম্প্রদায়ের ‘হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যদিও তাঁর এই পেশার সম্পর্কে জানার আগেই প্রশ্ন উঠতে পারে সেকালে কি বাংলায় ডাক্তার ছিলনা? বা বিদ্যাসাগরের মত অন্যতর শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতের নাক গলানোর কি দরকার ছিল? যেখানে আয়ুর্বেদ কিংবা হাকিমি নয়, ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল খোদ মেডিক্যাল কলেজও। ফলে এর একমাত্র উত্তর হল, আর্তদের সেবার উদ্দেশ্যেই বিদ্যাসাগরের এই উদ্যোগ। তাঁর হোমিওপ্যাথি চর্চার কেন্দ্রে ছিল দেশের দরিদ্র – অসহায় মানুষের বেদনার আর্তনাদ।
কিন্তু যার নাম ‘বিদ্যাসাগর’, তিনি কী শুধুই একটি উদ্যোগ নেবেন? নাকি সেখানেই গেঁথে যাবেন একটি মাইলফলক? অধ্যাপক ক্ষুদিরাম বসু জানিয়েছিলেন, তাঁর একবার পেটের সমস্যা বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ডঃ প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার, ব্রজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওষুধ কাজ দিচ্ছিলনা। বিদ্যাসাগর তাঁকে দেখতে এসে বই খুঁজে খুঁজে ওষুধ দিলেন, দু-তিনবার সেই ওষুধ খাওয়ার পর সম্পুর্ন সুস্থ হয়েছিলেন তিনি। কারমাটারে থাকার সময়েও তীব্র ম্যালেরিয়া, কলেরায় ভোগা রোগীকে (সাওতাল) সুস্থ করে তুলেছিলেন শুধু ওষুধে নয়, পরম যত্নেও। ১৮৬৯-৭০ সালে বর্ধমানে এক ভয়ানক জ্বরে (ম্যালেরিয়া) প্রচুর মানুষ মারা যায়।সেই সমস্ত মানুষদের বিনা পয়সায় ওষুধ দিয়ে সুস্থ করে তোলেন বিদ্যাসাগর
সারা জীবন অজস্র ব্যধিতে ভুগেছেন বিদ্যাসাগর। বীরসিংহ গ্রামে শৈশবে প্লীহার অসুখে আক্রান্ত হওয়া থেকে শুরু করে ক্রনিক পেট ব্যথা, রক্ত আমাশা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী । ফলে সেটিও তাঁর হোমিওপ্যাথি চর্চার অন্যতম বিষয়। যদিও শুধু চিকিতসা করে রোগীকে সুস্থ করে তোলাই নয়, বিদ্যাসাগর আবিস্কার করে ফেলেছিলেন হোমিওপ্যাথির অন্যতম একটি ওষুধও।
হাঁপানির রোগ থাকায় বিদ্যাসাগর শীতকালে খুব কষ্ট পেতেন । তাই শীতে দু’বেলা গরম চা খেতেন। এক দিন চা খাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাঁপের টান একদম কমে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অবাক! গৃহভৃত্যকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আজ চায়ে কি আদার রস মিশিয়েছিলে?’’
গৃহভৃত্য বলল, না সেরকম কিছু সে করেনি। এবং স্বীকার করল, তাড়াহুড়োয় আজ কেটলি না-ধুয়েই চা করে ফেলেছিলেন। কেটলি আনার পর কেটলি খুলে দেখে বিদ্যাসাগর স্তম্ভিত। কেটলির মধ্যে দুটি আরশোলা পড়ে আছে। বিদ্যাসাগরের অনুসন্ধিৎসু মন বলল, আরশোলা বেশি জলে সেদ্ধ করার পর, তাকে অ্যালকোহলে ফেলে ছেঁকে ডাইলিউট করে হোমিয়োপ্যাথির মতে ওষুধ বানিয়ে নিজে ও অন্যদের দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়, তাতে হাঁপানি, সর্দি সারে কি না!।
ভুবনকৃষ্ণ মিত্র তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, বহু রোগীকে না জানিয়ে তিনি এই ওষুধ খাওয়ান। এবং সাফল্য পাওয়ার পর রীতিমতো ব্যবহার হতে শুরু করে তাঁর তৈরি ব্লাট্টা অরিয়েন্টালিস (Blatta orientalis)। নামিদামী ডিগ্রীধারী ডাক্তারদের পাশে ‘মেটিরিয়া মেডিকায়’ এই ওষুধের প্রথম প্রয়োগকর্তা হিসেবে নাম আছে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরেরও।