কালের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস

অনুভব খাসনবীশ: উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে সাদা থান পরা বাল্য বিধবার ছড়াছড়ি। ওই সময়কার সাহিত্যিকদের লেখা বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসে আমরা বারবার…

Essay on Ishwar Chandra Vidyasagar

অনুভব খাসনবীশ: উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে সাদা থান পরা বাল্য বিধবার ছড়াছড়ি। ওই সময়কার সাহিত্যিকদের লেখা বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসে আমরা বারবার পড়েছি এদের দুঃখের কাহিনী। ধর্মের নামে, আচারের নামে, শাস্ত্রের নামে সেই সময়কার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের আদেশে এবং নির্দেশে বাল্যবিধবাদের উপর অত্যাচার করত সমাজ।

সেই অত্যাচার থেকে তাদের বাঁচানোর লক্ষ্যেই বিধবা বিবাহের প্রচলন করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যদিও বিদ্যাসাগরই যে বিধবা বিবাহ প্রচলনের আন্দোলন প্রথম উত্থাপিত করেছিলেন, এমন নয়। কলকাতায় ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮১৫ সালে। রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয় সভা’র বৈঠকেই বিধবা বিবাহ প্রচলন নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনার সূত্রপাত হয়।

   

রামমোহন লক্ষ্য করে দেখেছিলেন, ব্রিটিশ আমলে হিন্দু দায়ভাগ উত্তরাধিকার আইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী পুরুষের মৃত্যুর পর তার বিধবা পত্নীদের বিষয় সম্পত্তিতে কোনও স্বত্বাধিকারী স্বীকৃত হয় না। হিন্দু বিধবাদের এই শোচনীয় অবস্থার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ‘ব্রিফ রিমার্কস রিগার্ডিং মর্ডান এনক্রোচমেন্টস অন দ্য এ্যানসিয়েন্ট রাইটস অফ ফিমেলস’ প্রবন্ধে রামমোহন জানিয়েছিলেন, সতীদাহ ও বিধবা আত্মহত্যার সংখ্যা যে বেড়ে যাচ্ছে তার অন্যতম প্রধান কারণ হিন্দু নারীর এই অসহায় অবস্থা, যার জন্য শুধু ধর্মীয় কুসংস্কারই দায়ী নয়।

রামমোহন সেখানে লেখেন, “It is not from religious prejudices and early impressions only, that Hindu widows burn themselves on the piles of their deceased husbands, but also from their witnessing the distress in which widows of the same rank in life are involved, and the insults and slights to which they are daily subjected, that they become in a great measure regardless of their existance after the death of their husbands ; and this indifference, accompanied with the future reward held out of them, leads them to the horrible act of suicide.

অন্যদিকে, ১৮২৮ খ্রীস্টাব্দের পর থেকেই হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ইয়ং বেঙ্গলের উদ্যোগে বিধবা বিবাহের পক্ষে জনমত নেওয়া শুরু হয়। তাদের এই আন্দোলনের ফলেই ১৮৩৭ সালের ৩০শে জুন ইন্ডিয়ান ল কমিশনের সেক্রেটারী জে পি গ্র্যান্ট হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের জন্য আইন পাশের জন্য বিভিন্ন আদালতের বিচারকদের মতামত জানতে চান। কিন্তু প্রায় সকলেই হিন্দু সামাজিক প্রথাকে গুরুতর আঘাত করা হবে এবং এ জাতীয় আইন পাস করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে বলেই, তা বাতিল করে দেন।”

Iswar Chandra Vidyasagar: The Champion Of Women's Rights | Madras Courier

যদিও এতকিছুর পরে বিদ্যাসাগর প্রাথমিক ভাবে কেন বিধবাবিবাহ নিয়ে এগিয়ে আসেন তা নিয়ে উনিশ শতকে তাঁর দুই জীবনীকার বিহারীলাল সরকার এবং চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া ভাষ্য আলাদা। তাঁর ছোট ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের বক্তব্যটিই অনেকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেন (‘বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস’)। চণ্ডীচরণের বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির বালিকাবধূর অকালবৈধব্য বিদ্যাসাগরকে এই ‘মহৎ কর্মে ব্রতী’ হওয়ার জন্য প্রাণিত করে। অন্যদিকে বিহারীলাল লিখেছেন, বীরসিংহে বিদ্যাসাগরের এক বাল্যসহচরী ছিল। সে অকালে বিধবা হয়। এক দিন তিনি শুনলেন একাদশী বলে মেয়েটি সারা দিন খায়নি। আর শুনে তিনি কেঁদেই ফেললেন। এই দুটো ঘটনাই তাঁর ছাত্রজীবনে ঘটা।

আরও পড়ুন নয় দশক পেরিয়েও বঙ্গ জীবনের অঙ্গ; বোরোলিন

অন্যদিকে শম্ভুচন্দ্রের বলা ঘটনা বিদ্যাসাগরের কর্মজীবনের শেষ দিকের। তাঁর কথানুযায়ী, এক দিন বিদ্যাসাগর বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে বসে বাবার সঙ্গে স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সম্পর্কে যখন আলোচনা করছেন, তখনই তাঁর মা ‘রোদন করিতে করিতে’ সেখানে এসে ‘একটি বালিকার বৈধব্য-সংঘটনের উল্লেখ করত,’ তাঁকে বললেন ‘তুই এত দিন যে শাস্ত্র পড়িলি, তাহাতে বিধবাদের কোনও উপায় আছে কিনা?’ তাঁর বাবাও তখন জানতে চাইলেন, ধর্মশাস্ত্রে বিধবাদের প্রতি শাস্ত্রকারেরা কী কী ব্যবস্থা করেছেন? এর পরই নাকি ‘শাস্ত্র-সমুদ্র মন্থন’ করে তিনি লিখলেন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি, যা ১৮৫৪-র ফেব্রুয়ারিতে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-য় প্রকাশিত হয়। এর পরই তৎকালীন সমাজে সৃষ্টি হল প্রবল আলোড়ন।

ঠিক তখনই ১৮৫৫ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে তিনি প্রকাশ করলেন বিধবাবিবাহের সমর্থনে তাঁর প্রথম পুস্তিকাটি। নাম ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’। এতেই লেখা আছে সেই বহুখ্যাত শাস্ত্রীয় বচন যা বিদ্যাসাগর খুঁজে পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর ‘পরাশর সংহিতা’র শ্লোকে –
                                          “নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
                                           পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্য বিধিয়তে॥”
এই শ্লোকের অর্থ হল, স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হন, মারা যান, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করেন, ক্লীব বা পতিত হন, তাহলে এই পাঁচ প্রকার ক্ষেত্রে নারীর অন্য পতি গ্রহণ বিধেয়। পরবর্তীকালে অবশ্য জানা যায়, উদ্ধৃত শ্লোকটি ১৮৪২ সালে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর মুখপত্র ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে প্রথমবার ছাপা হয়েছিল। অবশেষে ১৮৫৬-র ২৬ জুলাই পাশ হল বিধবা বিবাহ আইন।

আরও পড়ুন ‘সুলেখা কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।’, বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি

এর পরেই ১২, কৈলাস বোস স্ট্রিটে (তখনকার সুকিয়া স্ট্রিট) রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেই হয় প্রথম বিধবা বিবাহ। তারিখটা ছিল ১৮৫৬-র ৭ ডিসেম্বর। পটলডাঙার লক্ষ্মীমণি দেবীর দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতির (বর্ধমানের পলাশডাঙার ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বিধবা কন্যা কালীমতি) সঙ্গে প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহ হয়। ব্রহ্মানন্দ মারা যাওয়ায় কালীমতির সম্প্রদান করেছিলেন তাঁর মা লক্ষ্মীদেবী। ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ এই বিবাহ এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৫ অগ্রহায়ণ বিয়ের দিন স্থির হলেও শ্রীশচন্দ্র নাকি ‘সময়কালে মাতৃপ্রতিবন্ধকের ছল করিয়া প্রতিজ্ঞাভঙ্গ’ করেন। পত্রিকায় আবার লিখেছে, ‘লোকে কহিতেছে’ পাত্রী বিধবা নয়, ন্যায়রত্ন মহাশয় অনেক টাকা দিয়ে কুমারী মেয়ে কিনে এনেছেন।

সেই সময়ের নিরিখে বিদ্যাসাগর বিপুল খরচ করেছিলেন বিয়েতে। কালীপ্রসন্ন সিংহ, পণ্ডিত প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের মতো তাবড় শিক্ষাবিদরা উপস্থিত ছিলেন সেই রাতে। রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের ‘আ-যৌবন সুহৃদ’। তাঁর বাড়িতেই রচিত হয়েছিল সেই অধ্যায়, যা হিন্দু-সমাজকে চালিত করেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে। বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, প্রথম বিয়েটি এ বাড়িতেই দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যদিও সেই বাড়িটি এখন ভাগ হয়ে গিয়েছে নানা মালিকানায়। গবেষকদের মতে প্রথম বিধবা বিবাহ হওয়ায় ওই বাড়িতে একটি ফলক ছিল। শুধু ফলকই নয়, ছিল আরও বেশ কয়েকটি স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু সে সবের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না এখন।

অন্যদিকে, ১৯৬১-তে শ্রীপান্থ লিখেছেন, সুকিয়া স্ট্রিটের এই অংশের নাম আজ কৈলাস বোস স্ট্রিট। বাড়ির সংখ্যাও আর ‘১২’ নেই। পরবর্তী কালে সুনীল মুন্সি (১৯৭৪) এবং রাধারমণ মিত্রও (১৯৭৭) কৈলাশ বোস স্ট্রিটের ‘৪৮’ নম্বর বাড়িটিকেই অতীতের ১২ নং বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও ওই বাড়ির বর্তমান বাসিন্দাদের বক্তব্য, তাঁরা সে সব সম্পর্কে কিছু জানেন না। কান পাতলে শোনা যায়, যদি এ বাড়ি হেরিটেজ ঘোষণার তোড়জোড় শুরু হয়, তা হলে তাঁরা বিপদে পড়বেন। সেই ভয়েই সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যকে কালের গহ্বরে চিরতরে পাঠিয়ে দেওয়ার এই অপচেষ্টা?