নাৎসি জার্মানির বুকের উপরে বসে হিটলারের চোখে চোখ রেখেছিল তারা, জেনে নিন সেই ইতিহাস

মিউনিখের লুডউইগ ম্যাক্সমিলিয়ান ইউনিভার্সিটির ৫৫০ বছরের পুরনো বাড়িটার ভিতরে ঢুকলেই একটা বিশাল চত্বর। তার একটি দেওয়ালে এই ছোট্ট মূর্তিটি বসানো রয়েছে। মেয়েটির নাম সোফি শল।…

fight against fascism

মিউনিখের লুডউইগ ম্যাক্সমিলিয়ান ইউনিভার্সিটির ৫৫০ বছরের পুরনো বাড়িটার ভিতরে ঢুকলেই একটা বিশাল চত্বর। তার একটি দেওয়ালে এই ছোট্ট মূর্তিটি বসানো রয়েছে। মেয়েটির নাম সোফি শল। শহীদ সোফি শল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সোফি, তার ভাই হান্স, হান্সের বন্ধু আলেক্সান্দার শমরেল, ক্রিস্টফ প্রবস্ট, উইল গ্যাফ, জুগেন উইটেনস্টাইন, তাদের শিক্ষক কার্ট হুবার সহ অনেকে মিলে লিখেছিল নাৎসি বিরোধী প্রতিরোধের মহাকাব্য। গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধী গ্রুপ ‘হোয়াইট রোজ’। নাৎসি প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে তারা জার্মানির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিল যুদ্ধোন্মাদ হিটলারের বিরুদ্ধে লেখা হাজার হাজার কপি লিফলেট।

শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি। এই হলঘরে লিফলেট ছড়িয়ে দেওয়ার সময় হান্স এবং সোফি গেস্টাপোদের হাতে ধরা পড়ে। তারপর আস্তে আস্তে ধরা পড়ে বাকিরাও। সোফি, হান্স, শমরেল, প্রবস্ট, কার্ট সহ অনেকের প্রাণদণ্ড হয়। কাউকে গিলোটিনে পাঠায় নাৎসিরা। কেউ ফাঁসির দড়িতে ঝোলে। অনেকের জন্য বরাদ্দ হয় কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের জীবন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতিহাস নাৎসিদের পক্ষে ছিল না। সোফি, হান্স এবং তাদের কমরেডরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে লিখেছিল মুক্ত পৃথিবীর ইস্তেহার।

সোফি এবং হান্সের জন্ম ফ্রচটেনবার্গ শহরে। ১৯৩২ সালে, ন্যাশনাল সোস্যালিস্টরা যখন দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি করছে, শল পরিবার তখন থাকতে শুরু করে উলম শহরে। পরের বছর, ১৯৩৩ সালে নাৎসি পার্টি জার্মানির ক্ষমতায় আসে। হিটলারের জনপ্রিয়তা তখন আকাশছোঁয়া। দলে দলে তরুণ নাৎসি পার্টিতে নাম লেখাচ্ছে। হান্স এবং সোফিও অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে যোগ দেয় হিটলারের দলে। হান্স কাজ করতে থাকে হিটলার ইয়ুথে, সোফি সক্রিয় হয় জার্মান লিগ অফ গার্লসে।

খুব দ্রুত শল ভাইবোনরা নাৎসিদের আসল চেহারা বুঝতে শুরু করে। ১৯৩৬ সালে হান্স নাৎসি পার্টির পতাকাবাহক হিসাবে ন্যুরেমবার্গ মিছিলে অংশ নেয়। ফিরে আসে নাৎসিদের প্রতি তীব্র বীতরাগ নিয়ে। সোফিও ততদিনে কট্টর নাৎসি বিরোধী হয়ে উঠেছে। জার্মানি জুড়ে তখন চলছে ঝঞ্ঝাবাহিনীর দাপট। বিরোধীদের উপর নেমে আসছে ভয়াবহ অত্যাচার। শুরু হয়ে গিয়েছে বই পোড়ানোর ভয়াবহ মহোৎসব। আর এই সব কিছু দেখতে দেখতে সোফি এবং হান্স হয়ে উঠছে কট্টর নাৎসি বিরোধী।

এর কিছুদিন পরেই শুরু হল বিশ্বযুদ্ধ। হান্স তখন ডাক্তারি পড়ছে মিউনিখে। বাধ্যতামূলক ভাবে তাকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাঠানো হল ইস্টার্ন ফ্রন্টে। কিছুদিন পর সে মিউনিখে ফিরল ঠিকই, কিন্তু তার বুকে তখন দাউদাউ করছে নাৎসিদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন।

১৯৪২ সাল। সোফিও ভর্তি হল মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। সেই সঙ্গে গোটা দেশ জুড়ে চলছে ভয়াবহ নাৎসি সন্ত্রাস। ভাই-বোন মিলে সিদ্ধান্ত নিল, যে ভাবে হোক গড়ে তুলবে প্রতিরোধ। দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে নাৎসি বিরোধিতার বার্তা।

হান্স তার বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলল হোয়াইট রোজ গোষ্ঠী। ক্রিস্টফ, আলোক্সান্দার, উইল, জুগেন সহ অনেকে জুটে গেল। কারও বয়সই ২২-২৩-২৪ পেরোয়নি। যোগ দিলেন অধ্যাপক কার্ট হুবার। শুরু হল নাৎসি জার্মানির পেটের ভিতরে প্রতিরোধের মহাকাব্য লেখার প্রস্তুতি।

হোয়াইট রোজ সিদ্ধান্ত নিল, লিফলেট লিখে ছড়িয়ে দেওয়া হবে জনতার মধ্যে। হান্স, ক্রিস্টভরা শিখে নিল ছাপাখানার কাজ। লেখা হল লিফলেট। ছাপানো হল গোপনে। ১৯৪২ সালেই বিলি করা হল প্রথম লিফলেট। তারপর এক এক করে আরও ৫টি। টাকাপয়সার অনেকখানি জোগালেন স্টুটগার্টের ইউজেন গ্রিমিংগার। তাঁকেও পরে গ্রেফতার করে গেস্টাপোরা। ইউজেনের স্ত্রী জেনিকে খুন করা হয় আউশভিৎসে। কত মানুষ যে জুড়ে গিয়েছিলেন এই প্রতিরোধী মিছিলে! ইউজেনের সেক্রেটারি টিলি হান যেমন। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে লিফলেট ছাপানো, প্রাণ হাতে করে মিউনিখে গিয়ে সোফি, হান্সদের সঙ্গে যোগাযোগ করা- কী করেননি!

হোয়াইট রোজ তাদের লিফলেটে দাবি করেছিল, অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। সাধারণ মানুষের কাছে ইহুদী এবং বিরোধী মতাবলম্বীদের হত্যাকারী হিটলারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিল তারা। হান্স, সোফি এবং তাদের বন্ধুরা বলেছিল, মানবতার ঘৃণ্যতম শত্রু নাৎসিদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। হয় আজ, নয় কাল, নাৎসিদের হারতেই হবে।

সোফিরা লিফলেট পাঠাত ডাকযোগে। গেস্টাপোদের নজর এড়িয়ে লিফলেট ছড়িয়ে দিতেন শহরের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, টেলিফোন বুথে, গির্জার সামনে, বাজার এলাকায় লিফলেট রেখে আসতেন তাঁরা। তাঁদের লিফলেট বলত সাম্য, শান্তি এবং গণতন্ত্রের কথা।

১৯৪৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। হিটলার রুশ রণাঙ্গনে রীতিমতো কোণঠাসা। নাৎসি বিরোধী প্রচারের স্বর আরও চড়িয়েছে হোয়াইট রোজ। মিউনিখের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ষষ্ঠ লিফলেটের কয়েকশো কপি নিয়ে এসেছে হান্স এবং সোফি। ক্লাস শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে গোটা করিডোরে লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছিল তারা। লেকচার রুমের বাইরেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রচুর লিফলেট। কিন্তু তার পরেও আরও কিছু বাকি রয়ে গিয়েছিল। সোফি সেগুলি নিয়ে তিনতলার ব্যালকনিতে ওঠে। তারপর ছড়িয়ে দেয় ফাঁকা করিডোরে। বিষয়টি নজর এড়ায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ তথা নাৎসি পার্টির কর্মী জ্যাকবের। সঙ্গে সঙ্গে খবর যায় গেস্টাপোর কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত দরজা বন্ধ করে ঘেরাও করা হয় হান্স এবং সোফিকে। পালানোর কোনও উপায় ছিল না।

হান্সের কাছে রয়ে গিয়েছিল সপ্তম লিফলেটের খসড়া। হাতের লেখা ছিল প্রবস্টের। তাকেও সহজেই গ্রেফতার করে গেস্টাপো। এরপর বিচারের নামে প্রহসন। বিচার চলার সময় বার বার বিচারককে থামায় সোফি। চিৎকার করে বলে, “জার্মানির পরাজয় আসন্ন। আপনারা কেন জনগণের কাছে সত্য লুকোচ্ছেন?”

বিচারে অন্য কিছু হওয়ার ছিল না। তিনজনকে একসঙ্গে গিলোটিনে খুন করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে বাকিরাও গ্রেফতার হতে থাকে। অনেকের প্রাণদণ্ড হয়, অনেকে জায়গা পায় কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই একটা ছোট্ট মিউজিয়মে যত্ন করে রাখা আছে হোয়াইট রোজ গোষ্ঠীর স্মৃতি। রয়েছে সবকটা লিফলেট, শহীদ ছেলেমেয়েদের ছবি, সংক্ষিপ্ত জীবনী। নাৎসি জার্মানির বুকের উপরে বসে হিটলারের চোখে চোখ রেখেছিল তারা। নাৎসিরা বহু চেষ্টা করেও হোয়াইট রোজ আন্দোলনের কথা চেপে রাখতে পারেনি। তাদের ষষ্ঠ লিফলেট পৌঁছে গিয়েছিল মিত্রশক্তির হাতে। সোভিয়েত লাল ফৌজ এবং মিত্রশক্তির অন্য দেশগুলির সেই লিফলেটের হাজার হাজার কপি বিমান থেকে ছড়িয়ে দিয়েছিল জার্মান সৈন্যদের মধ্যে।

সোফির এই ছোট্ট মূর্তিটি যেখানে রয়েছে, সেই হলঘরেই বই পুড়িয়েছিল নাৎসিরা। ১৯৩৩ সালে। ঠিক ১০ বছর পরে, ১৯৪৩ সালে এই হলঘরেই নাৎসি বিরোধী লিফলেট ছড়াতে গিয়ে ধরা পড়েছিল সোফি আর হান্স। সোফিদের মরতে হয়েছিল।