পাঞ্জাব কা পুত্তরের অভাবনীয় লড়াই, জান বাঁচিয়েছিল মুজিব কন্যা হাসিনার

আজ বিজয় দিবস। অর্ধ শতাব্দী আগে আজকের দিনেই যৌথবাহিনীর সামনে আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেয় এক নতুন রাষ্ট্র, বাংলাদেশ । ইতিহাস জানে কীভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য…

Colonel Ashok Tara

আজ বিজয় দিবস। অর্ধ শতাব্দী আগে আজকের দিনেই যৌথবাহিনীর সামনে আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেয় এক নতুন রাষ্ট্র, বাংলাদেশ । ইতিহাস জানে কীভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল ভারত। এক পাঞ্জাব কা পুত্তর না থাকলে আজ হয়তো উনি প্রাণে মারা যেতেন শেখ হাসিনা (Seikh Hasina )।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারতীয় মেজর জেনারেল গন্ধর্ব সিং নাগরা একটি চিরকূট পাঠান তার এককালের সহযোদ্ধা লেফটেনান্ট জেনারেল নিয়াজিকে। ‘‌প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।’‌  তার পরের ইতিহাস সকলের জানা। মিত্রবাহিনীর কাছে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করলো পাকিস্তানি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি।

পাক হাই কম্যান্ড অবশ্য তার আগের দিনই যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বড় এলাকা তখনও পাক বাহিনীর দখলে। হয় সেই বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের খবর পৌঁছয়নি। নয়তো সেসব এলাকায় পাক সেনা তখনও অনড়, জমি ছাড়ব না। নিজেদের পরাজয় বিশ্বাসই করে উঠতে পারছিল না বাহিনীর একাংশ।

সে রকমই এক জায়গা হল ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি। বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের বাড়ি। ২৫শে মার্চ গ্রেপ্তার হন তিনি। তার পর থেকে সেই বাড়িতে কড়া পাহারা। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, সন্তানদের গৃহবন্দি করে রেখেছিল পাক সেনা। বাড়ির সামনে রাখা ছিল ভারি মেশিনগান। বালির বস্তা। ছাদে বাঙ্কার বানিয়েছিল তারা। ২৪ ঘণ্টা চলত কড়া প্রহরা। এক মুহূর্তের জন্য না কেউ বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পেরেছে না কেউ বেরুতে পেরেছে।

ওই বাড়িতে মোতায়েন বাহিনীর কাছেও বাইরের জগত সম্পর্কে কোন খবর ছিল না। পাক বাহিনীর ওপরতলা থেকে তাদের কাছে খবর পৌঁছনোর কোনও চেষ্টাও হয়নি। ধানমন্ডির সেনা দলের কম্যান্ডিং অফিসার তার দু’‌–তিন দিন আগে থেকেই বেপাত্তা। বাকি সব অফিসাররাও ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ স্মরণ করে এই জওয়ানদের ফেলেই গা ঢাকা দেয়।

তাই আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধ শেষ হলেও শান্তি কিন্তু পরদিন থেকেই আসেনি। মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে ভারতীয় মেজর জেনারেল জ্যাকব খবর পেলেন শেখ মুজিবের বেগম, তরুণী দুই কন্যা রেহানা, হাসিনা ও তার ছেলে মেয়ে পুতুল ও জয় সহ পুরো পরিবারকে আটক রাখা হয়েছে ধানমণ্ডির একটি বাড়িতে। পাহারায় আধুনিক হাতিয়ারে সজ্জিত ডজন খানেক পাক সেনা। উদ্ধার করে আনতে হবে অথচ কারো আঘাত যেন না লাগে।গুরুত্বপূর্ণ এই রেসকিউ মিশনের ভার পেলেন “বীরচক্র” সম্মানে ভূষিত তিরিশ বছর বয়সী 14 গার্ড রেজিমেন্টের এক মেজর।

অত্যন্ত গোপন এই মিশনে মেজরের সাথী ছিলেন ভারতীয় সেনার তিন কম্যান্ডো। পরদিন সকাল নটা নাগাদ জিপসি গাড়িতে তারা যাত্রা করলেন ধানমন্ডির সেই বিশেষ বাড়িটির দিকে। কিন্তু বাড়ির একশো মিটার আগে একটা পোড়া টয়টা গাড়ি আর মানুষের ভিড় দেখে থামতে বাধ্য হলেন। ভেতরে তখনো চালকের সদ্যমৃত দেহ। উপস্থিত লোকজন জানালো ভোরের দিকে গাড়িটি ঐ বাড়ির দিকে যাবার চেষ্টা করলে ছাদ থেকে রকেট ছোড়ে পাকসেনা।
বিস্মিত সেনা ও মানুষের চোখের সামনে গাড়ি ছেড়ে একা পায়ে হেঁটেই এগোলেন মেজর। হোলস্টার থেকে সার্ভিস রিভলবারটাও রেখে এলেন গাড়িতে। বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়ানো এক তরুণ পাকসেনা কারবাইন উঁচিয়ে তাকে থামতে বললো। শুরু হলো এক স্নায়ু যুদ্ধ !
ভারতীয় সেনার উর্দি দেখে ছাদ থেকে এক পাকসেনা চেঁচিয়ে বললো আর এগুলে সেতো মরবেই, বাড়ির ভেতরে থাকা মহিলারাও মরবে !
এবারে একটা সুবিধা পেলেন ভারতীয় মেজর…. কথা শুনে বুঝলেন পাকসেনারা পঞ্চনদের বাসিন্দা আর ঘটনাচক্রে তিনিও তাই । বিদেশ বিভুঁইয়ে মাতৃভাষা শুনতে পেলে কেনা খুশি হয়, আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগালেন পাঞ্জাবী তনয়।

চোস্ত গুরুমুখী ভাষায় তাদের বললেন পাকিস্তান গতকালই আত্মসমর্পণ করেছে সেটা তারা জানে না। আর তা নাহলে কি এক ভারতীয় মেজর এভাবে খালি হাতে তাদের সামনে আসতে পারে? কথা বলতে বলতে পৌঁছে গেলেন একদম বাড়ির দোরগোড়ায়। ততক্ষণে পাকসেনাদের উদ্যত অস্ত্র নেমে এসেছে। তাদের তিনি আশ্বস্ত করলেন অস্ত্র সমর্পণ করে মুজিব পরিবারকে ছেড়ে দিলে নিজে উদ্যোগ নিয়ে তাদের দেশে পাঠিয়ে দেবেন, নইলে মুক্তি বাহিনীর হাতে পড়লে বাঁচার কোন আশা নেই। কাজ হলো এতে, তারা ঐ মেজরের কাছে আত্মসমর্পণ করলো, অক্ষত দেহে মুক্ত হলো গোটা মুজিব পরিবার ! বাড়িতে ঢুকতেই বেগম মুজিব তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘‌তুমি আমার ছেলে বাবা।’‌ বাড়িতে কোনও আসবাবপত্র ছিল না সেসময়, মেঝেতে ঘুমাতেন সবাই। খাবার বলতে ছিল শুধু বিস্কুট আর জল।

তার এই অবদান ভোলেননি সেদিনের মুজিব কন্যা ও আজকের প্রধানমন্ত্রী। ২০১২ সালে ভারতে এসে খোঁজ নেন তার। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর ‘‌মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সন্মাননা পদক’ দিয়ে বাংলাদেশ সরকার সম্মানিত করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কর্ণেল অশোক তারা কে!