ফাঁসির মুহূর্তেও নিরুত্তাপ, হুতাত্মার দেহ ভষ্ম পেতে পাগল হয়েছিল তিলোত্তমা

Special Correspondent, Kolkata: তাঁকে ফাঁসির সাজা শোনানোর সময় বিচারক প্রথামাফিক জানালেন, উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের সুযোগ রয়েছে। তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, “আবেদন? কিসের…

freedom fighter Kanailal Dutt

Special Correspondent, Kolkata: তাঁকে ফাঁসির সাজা শোনানোর সময় বিচারক প্রথামাফিক জানালেন, উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের সুযোগ রয়েছে। তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, “আবেদন? কিসের আবেদন?”। তিনি কানাইলাল দত্ত। যার মৃতদেহের ভষ্ম পেতে শহরে হইহই পড়ে গিয়েছিল।

কুড়ি বছর বয়সী কানাইয়ের ফাঁসির দিন ধার্য হল ১৯০৮-এর ১০ই নভেম্বর আজকের দিনে। কাকভোরে জেলে উপস্থিত হলেন খোদ নগরপাল হ্যালিডে সহ লালবাজারের পদস্থ কর্তারা। সকাল ছ’টায় কানাইলালকে নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসির মঞ্চে। কানাই ছিলেন অচঞ্চল, তাপ উত্তাপহীন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে পাওয়া যায়, কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দেওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন স্মিতহাস্য। ফাঁসির সময় উপস্থিত ছিলেন, এমন একজন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার পরে বারীনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “How many more do you have like him?” এমন আরও কতজন আছে কানাইয়ের মতো? নিরুত্তর ছিলেন বারীন, মৃদু হেসেছিলেন শুধু।

আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার গতিপ্রকৃতি তুমুল আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল বঙ্গসমাজে। নরেন-হত্যায় অভিযুক্ত দুই যুবককে কেন্দ্র করেও সর্বস্তরে স্রোত বইছিল সহানুভূতির। যা অজানা ছিল না প্রশাসনের। কানাইলালের মরদেহ নিয়ে মূল রাজপথ দিয়ে শোভাযাত্রার অনুমতি দিলেন না নগরপাল। টালি নালার পার্শ্ববর্তী গলিঘুঁজি দিয়েই শ্মশানযাত্রা হবে, নির্দেশ জারি হল। আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় ফোর্ট উইলিয়াম থেকে তলব করা হল রিজার্ভ ফোর্সের তিনশো জওয়ানকে।

কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে কি আর বলপূর্বক রাশ টানা যায়? গিয়েছে কখনও? মরদেহ যখন পৌঁছল গলির গলি তস্য গলি পেরিয়ে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে, তখন মাত্রাছাড়া আকার নিয়েছে প্রতীক্ষারত জনসমাগম। আট থেকে আশি নেমে এসেছে রাস্তায়, শহীদবরণে। আশেপাশের বাড়িগুলির বারান্দা থেকে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে।
মহিলারা প্রস্তুত ফুল-মালা-ঘি-চন্দন নিয়ে, বয়স্কদের অধিকাংশের হাতে ভগবদগীতা। তরুণদের সম্মিলিত “বন্দেমাতরম”-এর গর্জন পরিণত শব্দব্রহ্মে। শহীদের দেহ ছুঁতে চাওয়ার আকুতিতে উত্তাল অপ্রশস্ত পথপরিসর। যানচলাচল স্তব্ধ জনস্রোতে। তুঙ্গস্পর্শী উন্মাদনাকে কোনোমতে নিয়ন্ত্রণে এনে যখন শেষকৃত্য সম্পন্ন হল যুবকের, ফের ঘটল আবেগের অগ্ন্যুৎপাত। পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া দেহের ছাইভস্ম দখলে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল উন্মত্ত জনতা। ক্রোধ-ক্ষোভ-শোকের বিরল ত্র্যহস্পর্শের সাক্ষী থেকেছিল শ্মশানপ্রাঙ্গন।

চন্দননগর যুগান্তর পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়ের অনুপ্রেরণায় কানাইলাল বিপ্লববাদে দীক্ষা নেন এবং ব্রিটিশ-ভারতে বিপ্লবীদের মুখপত্র যুগান্তর ও অন্যান্য পত্রিকা, বিভিন্ন বৈপ্লবিক আন্দোলনের ইতিহাস এবং দেশপ্রেমিকদের জীবনগাথা পাঠে উদ্বুদ্ধ হন। শ্রীশচন্দ্র ঘোষের সক্রিয় নেতৃত্বে উপেন্দ্রনাথ, নরেন্দ্রনাথ, বসন্তকুমার প্রমুখের গোন্দলপাড়া গোষ্ঠীর সঙ্গে কানাইলালের ঘনিষ্ঠতা হয়। শ্রীশচন্দ্রেরই ব্যবস্থাপনায় কানাইলাল আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও আয়ত্ত করেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চন্দননগর গোষ্ঠীর মধ্যে এক নব উদ্দীপনার সৃষ্টি করে, যার পুরোভাগে ছিলেন কানাইলাল। এ সময় চন্দননগরে বিলাতি বস্ত্রবর্জন আন্দোলনসহ ইংরেজবিরোধী অসংখ্য স্থানীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কানাইলাল খ্যাতি অর্জন করেন।

বিএ পরীক্ষা শেষে কলকাতায় বারীন্দ্রকুমার ঘোষ পরিচালিত গুপ্ত বিপ্লবী গোষ্ঠীর কার্যকলাপে কানাইলাল সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং ভবানীপুরের এক গৃহে গোপনে কর্মময় জীবন অতিবাহিত করেন। পরে তিনি বাগবাজারের ১৫ গোপীমোহন দত্ত লেনে চলে যান, যেখানে ছিল বিপ্লবীদের জন্য অস্ত্র ও বারুদের ভান্ডার।
১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসুর কিংসফোর্ড হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ২ মে অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ও অন্যান্যের সঙ্গে কানাইলালও গ্রেপ্তার হন। তাঁদের আলীপুর জেলে (বর্তমান প্রেসিডেন্সি জেল) রাখা হয়।

এ মামলার অন্যতম আসামি নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী প্রাণ বাঁচাতে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হওয়ায় বিপ্লবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯০৮ সালের ৩১ আগস্ট দলপতির নির্দেশে কানাইলাল অপর বন্দি বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সহযোগিতায় জেল হাসপাতালের ভেতরই নরেন গোস্বামীকে হত্যা করেন। বিচারে কানাইলালের ফাঁসির আদেশ হয়। এ খবর শুনে তিনি তাঁর জন্য কাউকে আপিল করতে নিষেধ করেন। বিনা আপিলে ১৯০৮ সালের ১০ নভেম্বর ফাঁসিকাষ্ঠে আরোহণ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন নির্বিকার, স্বাভাবিক।