Bengali theatre: রুশ সাহিত্যিকের হাত ধরে শুরু হয়েছিল বাঙালির নাটক যাত্রা

Pioneer of Bengali theatre বিশেষ প্রতিবেদন, কলকাতা: বাঙালির জন্য প্রথম বাংলা ভাষায় নাটক রচনা,থিয়েটার প্রতিষ্ঠা এবং সেই থিয়েটারে ভারতীয় তথা বাঙালিদের অবাধ প্রবেশের অধিকার যে…

Russian writer Gerasim Stepanovich Lebedev

Pioneer of Bengali theatre
বিশেষ প্রতিবেদন, কলকাতা: বাঙালির জন্য প্রথম বাংলা ভাষায় নাটক রচনা,থিয়েটার প্রতিষ্ঠা এবং সেই থিয়েটারে ভারতীয় তথা বাঙালিদের অবাধ প্রবেশের অধিকার যে ভদ্রলোক দিয়েছিলেন তিনি কোনও বাঙালি বা ভারতীয় নন তিনি একজন রুশ,যিনি ভারত ও বাংলাকে গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন, ভদ্রলোকের নাম গেরাসিম স্টেপোনোভিচ লেবেদেফ,তিনিই প্রথম পশ্চিমি বাদ্যযন্ত্রে ভারতীয় সুর বাজিয়েছিলেন৷

লেবেদেফ কলকাতায় এসেছিলেন ১৭৮৭ সালের আগস্ট মাসে, তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইংরেজি নাটকের বাংলা অনুবাদ করে নাট্যমঞ্চে বাঙালি অভিনেতাদের দিয়ে প্রথম বাংলা নাটক অভিনয় করিয়েছিলেন আজকের এজরা স্ট্রিটে বাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাঙালি থিয়েটার নাম ‘দি বেঙ্গলি থিয়েটার’৷ বাংলা নাটকের ইতিহাসের এই মাইলফলকের ঠিকানা ছিল তৎকালীন কলকাতার ২৫, ডোমতলা, বর্তমানে যা ৩৭, এজরা স্ট্রিট। সেই থিয়েটারে প্রায় ৩০০দর্শক বসতে পারতেন, প্রথমবার অভিনয়ের জন্য জোগাড় করেছিলেন তিনজন অভিনেত্রী দশজন অভিনেতা তারা সকলেই ছিলেন বাঙালি৷

   

বাঙালি সমাজে খবরটা ছড়িয়েছিল ঝড়ের বেগে,লেবেদেফ ক্যালকাটা গেজেটে বিজ্ঞাপন দিলেন ১৭৯৫ সালের ২৭নভেম্বর, শুক্রবার ‘The Disguise’ ( কাল্পনিক সংবদল) নামে একটি কমেডি অভিনীত হবে৷।আত্মকথায় লেবেদেফ বলেছেন উপস্থিত দর্শকের তুলনায় আসন আরও তিনগুণ থাকলেও ভরে যেত৷ কারা এসেছিলেন দর্শক হয়ে?.

pioneer of Bengali theatre

নিশ্চিতভাবে তারা এসেছিলেন শ্বেতাঙ্গসমাজে কিছুটা অবজ্ঞা পাওয়া এবং কৌতূহলের বশে সেইসব গন্যমান্য বাঙালি সেদিন ‘বেঙ্গলি থিয়েটারে’উপস্থিত হয়েছিলেন যারা সাহেবদের রঙ্গালয়ে প্রবেশের সাহস করতেন না,যদিও সেদিন প্রবেশমূল্য নিতান্ত কম ছিল না৷ লেবেদেফের আশঙ্কা ছিল বাংলা ভাষার এই নাটক ইংরেজরা বুঝবে না,সমালোচনা হবে!হল উল্টো,এমন কি অনেকেই সম্পূর্ণ নাটকটি দেখতে চাইলেন,স্বয়ং প্রধান বিচারপতি জন হাইড ঈস্ট,লেবেদেফকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন ফলে ১৭৯৬সালের ২১মার্চ ক্যালকাটা গেজেটে আবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হল,২৪মার্চ তৃতীয়বার বিজ্ঞাপন দিলেন লেবেদেফ৷মূল ইংরেজি নাটকটির ঘটনাস্থল স্পেন,মাদ্রিদ ও সেভিল শহর৷কিন্তু বাঙালি দর্শকদের কাছে দুটি নাম অপরিচিত হতে পারে মনে করে তিনি নাটকে কলকাতা ও লক্ষ্ণৌ শহরের নাম ব্যবহার করেছেন,এবং নাটকের চরিত্রদের নাম দিয়েছেন দেশীয়৷

যেমন ভোলানাথ(নায়ক),সুখময়,ভাগ্যবতী,রতনমণি,তিনকড়ি ও পাঁচকড়ি৷বাংলা ভাষায় ‘Disguise’-এর নাম ছিল ‘কাল্পনিক সংবদল’৷নাটকের বিদেশী স্বাদগন্ধ ছড়িয়ে দেশীয় রূপ দিতে লেবেদেফ যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন৷বাঙালি সমাজ এর আগে কোনও বাংলা নাটকের কোনও মঞ্চাভিনয় দেখেনি,তাই দৃশ্যসজ্জা,সাজপোষাক,নৃত্যগীত,অর্কেস্ট্রা বাদন,আলোকিত(অবশ্যই বাতির আলো) পাঠ্যপীঠ দেখে তারা মুগ্ধ হয়েছিলেন৷যাই হোক লেবেদেফ কে আমরা শ্রদ্ধা করি,কারণ তিনি আমাদের জন্য প্রথমবার বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে বাংলা নাটক রঙ্গমঞ্চে উপস্থাপিত করেছেন,কলকাতায় থাকার সময় এবং শহর থেকে চলে গিয়েও অনেক দুঃখ পেয়েছেন,বাংলা নাটক ও নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয়, বরণীয়,পাদপ্রদীপ৷ জন্মগ্রহন করেছিলেন ১৭৪৯সালে ইউক্রেনে,বাল্যকাল থেকে ছিল সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের প্রতি অমোঘ টান৷ইতালিতে থাকার সময় দক্ষ বেহালা বাদক হয়ে উঠেছিলেন৷১৭৮৫সালের ১৫আগস্ট এসেছিলেন ভারতে,পৌঁছেছিলেন মাদ্রাজ শহরে৷কিন্তু মনের আশা পূর্ণ না হওয়ায় ওই শহর ছেড়ে ১৭৮৭সালে কলকাতায় এলেন,বেহালায় সুর তুলে আমাদের প্রিয় কলকাতায় জীবিকা অর্জন করতে লাগলেন৷শ্রোতার দল তাঁর গীতবাদ্যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উঠেছিলেন৷দিনে দিনে তাঁর খ্যাতি তখন মধ্যগগনে৷

১৭৯০সালের ৯ এপ্রিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের সভায় গান গেয়ে ও বেহালা বাজিয়ে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন,ওই আসরে প্রতিটি টিকিটের দাম ছিল সিক্কা ১২টাকা, সেকালের হিসেবে গানশোনার দর্শনী যতেষ্ট মহার্ঘ্য ছিল বলতেই হয়৷পরিচয় হয়েছিল বাঙালি গোলোকনাথ দাসের সঙ্গে,তাঁর কাছেই লেবেদেফের বাংলা শিক্ষা,আর গোলোকনাথ দাস বন্ধুর কাছে শিখলেন সঙ্গীত৷তবে ইংরেজদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন নি রুশ লেবেদেফ,সেইজন্য ইংরেজ নাট্যকারের ‘Disguise’ এবং মলিয়রের ফরাসি নাটক ‘love is the doctor’ কে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন৷ভাষা শিক্ষক গোলকনাথ দেশীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জোগাড় করেছিলেন৷সেই ইতিহাস আমাদের কারও জানা হয়ত অনেকের অজানা! তখন মাত্র দুটি রঙ্গমঞ্চ কলকাতায় একটি ‘দি বেঙ্গলি থিয়েটার’ অন্যটি ইংরেজদের ‘দি নিউ প্লে হাউস’।

শোনা যায়, লেবেদেফের জনপ্রিয়তায় ইংরেজরা ভয় পেয়েছিল। কিছু দিন পরেই তাঁর সেই তিনশো আসনবিশিষ্ট থিয়েটারে আকস্মিক ভাবে আগুন লেগে ছাই হয়ে যায় সব কিছু!তখন তিনি ‘Deserter’নামে একটি গীতিনাট্য অভিনয় করানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন৷লেবেদেফ সুবিচারের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হলেন,কিন্তু শ্বেতাঙ্গ উকিলরা তাঁর হয়ে আদালতে লড়তে রাজি হন নি সরকারি সাহায্য থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন কারন তিনি শুধু বাঙালিদের জন্য নাটক প্রযোজনা করেছিলেন৷অনেক বিপদ আর ঝড় এলো রুশ ভদ্রলোকের জীবনে,মিথ্যে ঋণের দায়ে গ্রেফতার হলেও কোনওক্রমে মুক্তি পেয়েছিলেন৷

অবশেষে ঋণগ্রস্ত লেবেদেফ ট্র্যাজেডির নায়কের মত তাঁর সাধের ‘দি বেঙ্গলি থিয়েটার’নীলামে বিক্রি করতে বাধ্য হলেন,এবং ওই ভাড়াবাড়ির মালিক জনৈক জগন্নাথ গাঙ্গুলি তাঁকে নানা ভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা করেন,তিনি দেহ মনে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷অবশেষে স্যার জন শোরের নিকট কাতর প্রার্থনা করে বড়লাটের নির্দেশে বিনা ভাড়ায় ‘লর্ড কারলো’নামে ইংল্যাণ্ডগামী জাহাজের এককোনে ঠাঁই পেয়ে এদেশ ছাড়লেন৷তারপরেও তাঁর জীবনে এসেছে অনেক বিপত্তি৷রুশ দেশের রাষ্ট্রদূত ওরোনজাওয়ের তৎপরতায় ফিরেছিলেন দেশে,সেখানে ভারতচন্দ্রের কাব্যের রুশ অনুবাদ করেছেন৷

শুধু এটুকু বলা যায় বাংলাকে গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন লেবেদেফ,তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি বাঙালিকে বাংলা থিয়েটারে বাংলা ভাষায় নাটক দেখার অবাধ সুযোগ করে দিয়েছিলেন৷

তথ্যসূত্র : বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত,অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়