National Milk Day 2021: দুধের জগতে ‘আমুল’ বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন তিনি

সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়: দেশের গ্রামীণ সমবায় শিল্পোদ্যোগকে ‘আমুল’ এর মাধ্যমে আমূল বদলে দিয়েছিলেন তিনি৷ যার হাত ধরেই দেশে এসেছিল শ্বেতবিপ্লব বা অপারেশন ফ্লাড সেই ভার্গিস কুরিয়েনের…

Verghese Kurien

সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়: দেশের গ্রামীণ সমবায় শিল্পোদ্যোগকে ‘আমুল’ এর মাধ্যমে আমূল বদলে দিয়েছিলেন তিনি৷ যার হাত ধরেই দেশে এসেছিল শ্বেতবিপ্লব বা অপারেশন ফ্লাড সেই ভার্গিস কুরিয়েনের (Verghese Kurien) জন্মদিন আজকে (২৬ নভেম্বর )৷

দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে আর তার সঙ্গে তাল রেখে দুধ উৎপাদনও জরুরি, আবার সমবায়ের ভিত্তিতে দুধ উৎপাদন বদলে দিতে পারে দেশের গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা অর্থনীতি ৷ সেটাই অনুভব করেছিলেন এই ‘দুধওয়ালা’, যার জেরে এখন দুধ উৎপাদনে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে ভারত ৷

   

সালটা ১৯৪৯, গুজরাতের আনন্দ জেলায় ত্রিভুবন দাশ প্যাটেলের সঙ্গে ছয় মাসের চুক্তিতে দুধের সমবায় কাজ করছিলেন ২৮ বছরের ভার্গিজ কুরিয়েন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে সেদিনের যুবকটি ব্যাগ গুছিয়ে মুম্বয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার কথা। তখন ত্রিভুবন দাস তাঁকে অনুরোধ করেন আরও কয়েকটা দিন থেকে যেতে, যাতে সমবায়টা আরও একটু মজবুত হয়৷ সে অনুরোধ ফেরাতে না পেরে থেকেই যান সেখানে৷ আর তার পরে ঘটনা তো ইতিহাস হয়ে গিয়েছে৷

১৯২১ সালে কেরলের কোঝিকোড়ে জন্মেছিলেন এদেশের শ্বেত বিপ্লবের জনক। চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে কিছুদিন জামশেদপুরে টিসকো-য় চাকরি করেন৷ এই সময় সরকারি স্কলারশিপ পান ডেয়ারি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। বেঙ্গালুরুর ‘ইম্পিরিয়াল ইন্সটিটিউট অফ অ্যানিমাল হাসব্যানড্রি অ্যান্ড ডেয়ারিং’-এ পাঠ শেষে যান আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকে ফিরে চুক্তিমাফিক আনন্দে দুধ থেকে ক্রিম তৈরির একটি সরকারি কারখানায় ঢুকেছিলেন। সেখানে স্থানীয় সমবায়, ‘কাইরা জেলা দুগ্ধ উৎপাদক সমবায়’-এর প্রধান ত্রিভুবনদাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

গুজরাতের গ্রামাঞ্চলে দুধ উৎপাদন রেওয়াজ বহুদিনের। সমবায় প্রথাকে কাজে লাগিয়ে দুধ উৎপাদকদের জীবনে পরিবর্তন আনার স্বপ্নটা দেখেছিলেন বল্লভভাই পটেল। তাঁরই উৎসাহে তৈরি হয়েছিল কাইরা জেলা দুধ উৎপাদক ইউনিয়ন। ১৯৪৯ সালে ওই সংস্থায় যোগ দিলেন কুরিয়েন। পরপরই একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য কুরিয়েনকে অনুরোধ করলেন স্বয়ং পটেল। আর কুরিয়েন গ্রামীণ ডেয়ারি শিল্পের খোলনলচে বদলানোর কাজে নেমে পড়লেন।

সেই সময় কয়েকটি বিষয় স্থির করা হয়েছিল৷ প্রথমত গ্রামীণ শিল্পকে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে আধুনিক শিল্পের রূপ দেওয়া। দ্বিতীয়ত গ্রামের মানুষকে নিয়েই শিল্প গড়ে তোলা। তৃতীয়ত সরকারি কোনও রকম সহায়তা নির্ভর না করে কাজ এগোবে। গান্ধীজির রাজ্যে কুরিয়েনের শিল্প-মডেল স্বনির্ভরতার নীতিতেই দাঁড়িয়েছিল। যা শুরু হয়েছিল মাত্র দু’টি গ্রাম নিয়ে, দিনে ২৪৭ লিটার দুধ উৎপন্ন হত। ১৯৫৫ সালের মধ্যে এর বিস্তার হল এতটাই যে দিনে দুধ উৎপাদন ২০ হাজার লিটার হল ।

শুধুমাত্র গরুর দুধে আটকে না থেকে মোষের দুধকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নিলেন কুরিয়েন। এই মানুষটি প্রথম মোষের দুধ থেকে গুঁড়ো দুধ তৈরির গবেষণা শুরু করেছিলেন, যার জেরে এদেশের প্রথম মিল্ক পাউডার প্লান্ট গড়ে ওঠে । তাছাড়া তিনি সেদিনই বুঝেছিলেন দুধ উৎপাদনের পাশাপাশি একটা ‘ব্র্যান্ড নেম’ দরকার। ফলে ১৯৫৫ সালে আত্মপ্রকাশ করল ব্র্যান্ড ‘আমুল’ হয়ে৷ শ্বেত বিপ্লব, অপারেশন ফ্লাড, ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, গুজরাত কোঅপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন… এভাবেই একের পর এক ধাপ পেরিয়ে যায় কুরিয়েনের কর্মযজ্ঞ ৷ ‘আমুলে’র সাফল্যে দেখে ১৯৬৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী উদ্যোগী হলেন ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (এনডিডিবি) গড়ার কাজে। কুরিয়েনকেই করা হল তার কর্ণধার । এই সময় তাঁর কাজের জন্য ১৯৬৫-তে পদ্মশ্রী ও ১৯৬৬-তে পদ্মভূষণ খেতাব দেওয়া হয়৷ ভারতের ডেয়ারি ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর অবদানের কথা মাথায় রেখে তাঁর জন্মদিন ২৬ নভেম্বর ন্যাশনাল মিল্ক ডে হিসেবে পালিত হয়।

১৯৭০ সালে দেশ জুড়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ‘অপারেশন ফ্লাড’-এ নামল এনডিডিবি। গুজরাটে অবশ্য তার আগেই ‘আমুল’-মডেল গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গিয়েছে। গোটা রাজ্যের দুগ্ধ সমবায়গুলিকে এ বার এক ছাতার তলায় আনলেন কুরিয়েন। ১৯৭৩ সালে গড়ে উঠল গুজরাত কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন। তার ফলে আনন্দ-এ সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা গুজরাটের প্রতীক হয়ে উঠল ‘আমুল’ যা গোটা দেশে স্বাদ জোগাল অদ্বিতীয় ব্র্যান্ড, ‘দ্য টেস্ট অফ ইন্ডিয়া!’ উৎপাদনের গুণমানের পাশাপাশি কুরিয়েন ব্যবহার করেছিলেন অনবদ্য প্রচার কৌশল। কোনও সেলিব্রিটির মুখ ধার না করে সাদার উপরে লাল ছিট ছিট জামা পরা এক বাচ্চা মেয়েকে তুলে ধরলেন প্রচারে যা পাঁচ দশক পেরিয়ে আজও অবিচল এক অন্য জনপ্রিয়তায়। শোনা যায় তিনি বিজ্ঞাপন সংস্থাকেও পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তাই লেখা হয়েছিল ‘আটারলি বাটারলি ডিলিশিয়াস আমুল’-এর মতো স্লোগান৷ যা প্রথমে কিছুটা অদ্ভূত শোনালেও তিনি বাধা দেননি৷

তবে ‘আমুল’ গুঁড়ো দুধ,মাখন থেকে শুরু করে ঘি, চকোলেট, চিজ, আইসক্রিম দই ইত্যাদি দুগ্ধজাত পণ্যেই থেমে থাকেন নি৷ গড়ে তোলেন ইন্সটিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট। চলচ্চিত্রেও সফল অংশীদার ৷ তাঁর ‘অপারেশন ফ্লাড’কে ভিত্তি করে শ্যাম বেনেগাল তৈরি করেন ‘মন্থন’ ছবিটি। এছবির গল্প লেখাতেই শুধু সাহায্য করেননি , ছবি করার জন্য প্রযোজক পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই শ্যাম বেনেগলকে সাহায্যে করতে এগিয়ে আসেন কুরিয়েন। তাঁর অনুরোধেই দুধ উৎপাদকেরা দু’টাকা করে চাঁদা দিয়ে ছবির তহবিল গড়ে তোলেন। যা আজ থেকে চার দশক আগেই এদেশের ক্রাউড ফান্ডিংয়ের এক উদাহরণ হয়ে রয়েছে। গিরিশ কারনাড-স্মিতা পাটিলকে নিয়ে তৈরি হল ‘মন্থন’। পরে ‘আমুলে’র বিজ্ঞাপনেও বেজেছে সেই গান, ‘মেরো গাম কথা পারে ঝা দুধ কি নদিয়া বাহে…।