সাধের নবান্নে ‍‘লবানে’ মাতে বীরভূম, লুকিয়ে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য

Nabanna festival: একসময় বীরভূম জেলায় দুর্গাপূজা খুব একটা জাকজমক হত না। গ্রীষ্মকালীন ধান বা ব্যাপক ভাবে আলু চাষ শুরু হবার আগে ভাদ্র আশ্বিন মাস ছিল…

Nabanna festival in birbhum

Nabanna festival: একসময় বীরভূম জেলায় দুর্গাপূজা খুব একটা জাকজমক হত না। গ্রীষ্মকালীন ধান বা ব্যাপক ভাবে আলু চাষ শুরু হবার আগে ভাদ্র আশ্বিন মাস ছিল খুব অভাবের। বর্ষার ধান পোতার পর সাধারণ চাষী বাড়িতে একটু অভাব দেখা দিত। কৃষি শ্রমিকদের কাজ কমে যেত। ফলে একটা কথাই ছিল ‘ ভাদ্রের অভাব ‘। ফলে এই কৃষি শ্রমিকরা অভাবে জিনিসপত্র বিক্রি করতে শুরু খুব কম দামে। যে সমস্ত গ্রামে বাবুদের বাড়ির পুজো ছিল সেই গ্রামেই দুর্গাপুজো হত। বারোয়ারি পুজো খুবই কম।

কালীর দেশ বীরভূমে কালীপূজা কিন্তু বেশ ধুমধাম করে। বিভিন্ন গ্রামে অনেক লম্বা লম্বা কালী ঠাকুর হত – আঠারো হাত, একুশ হাত – এমনি আরকি। শহরের পুজো গুলোতে তো বিশাল ধুমধাম।

বীরভূম জেলার গ্রামের গ্রামাঞ্চলে প্রধান উৎসব ছিল – নবান্ন। স্থানীয় ভাষায় – নবান বা লবান। বীরভূমে ‘ ন’ উচ্চারণে একটু গণ্ডগোল আছে। অঘ্রান মাসে চারদিক শুকনো হয়ে ওঠে। ধান কাটার শুরুতে সাধারণ কৃষি শ্রমিকদের হাতে কিছু টাকা পয়সা আসে- মানে অভাব কমে। তখন হয় নবান্ন।

আঘ্রাণ মাসে হয় নবান। এর নির্দিষ্ট কোন দিন নেই। গ্রামের মাতব্বররা বা বয়স্ক মানুষরা ( মাতব্বর কথাটা এখন যে অর্থেই ব্যবহার হোক, একসময় এটা খুব সম্মানের কথা ছিল) একসঙ্গে বসে বসে নবান্নের দিন ঠিক করত। অনেককিছু দেখা হত দিন ঠিক করার আগে। গ্রামে কোন অসুবিধা আছে কিনা, কোন বিয়ে আছে কিনা বা কেউ মারা গেছে কিনা- ইত্যাদি প্রভৃতি। কিছু কিছু গ্রামে আবার নির্দিষ্ট দিনই ছিল।

নবান্ন শুরু হবার আগে হত ‘ মুঠ’। মুঠ কথাটা এসেছে সম্ভবত ‘ মুঠি’ থেকে। মাঠ থেকে একমুঠো ধান কেটে পুজো দিয়ে হত মুঠ। এরপর শুরু হত ধান কাটা। এরপর কয়েকদিন পর নবান্ন।

মুলত খাবারের উৎসব এই নবান্ন। নবান্নের পর মানুষ নুতন চাল খাবার অনুমতি পায়। তাই নবান্নের প্রধান উপাদান নুতন চাল। নুতন চাল গুড়ো করে মাখা হয় ( খুব মিহি করে নয়, একটু কিড়কিড়ে থাকে)। মাখার মধ্যে থাকে ঘন দুধ, ক্ষীর, মন্ডা, বিভিন্ন ফলের কুচি- যেমন আপেল, কলা কমলালেবু, পানিফল, আখের কুচি, আদা , মুলো আর রাঙা আলু কুচি_ আরও কিছু থাকতে পারে। এটাই নবান্নের প্রসাদ। ঘরের ঠাকুর থেকে প্রকৃতি, পশুপাখিকে উৎসর্গ করে এই প্রসাদ খাওয়া হয়। তবে এই প্রসাদ কনিকা মাত্র নয়- প্রচুর পরিমাণে বানানো হয়। তার সঙ্গে কলা, মিষ্টি, ঘরের তৈরি নাড়ু, পান্তুয়া, আরও যে যেমন পারে। বীরভূম জেলা চিরকালই মিষ্টি বা টকের দেশ – ঝাল খাবারের কোন ব্যাপার নেই। খেতে খুবই ভালো লাগে এই এই চালগোলা। তবে পেটরোগা লোকেদের কাছে খুবই গুরুপাক খাবার।

তখন চাষীদের যৌথ পরিবারে লোকজন প্রচুর। তারপর কৃষিতে এই এত যন্ত্রপাতি ছিল না। তাই লোক লাগত অনেক। বাড়িতে থাকত গোরুবাছুর বা মোষ বলদ। এদের দেখাশোনা করার জন্যও লাগত লোক। তাই বাড়িতে বেশ কিছু বাধা লোক কাজ করত যাদের বলা হত মান্দের, বাগাল। তারা ছিল। আত্মীয়স্বজনদের বলা হত।

নবান্নের বাজার হত বড়োসড়ো। দুতিন কাঁদি কলা, ডজন দুই তিন নারকেল, পাঁচ ছ কেজি মিষ্টি ( তখন গ্রামে মিষ্টি বিক্রি হত কেজিতে), কেজি পাঁচেক চিনি – এরকম আকছার হত। দুধ তো বাড়িতেই ছিল। পুকুরে জাল ফেলা হত কাতলা মাছের জন্য। সকালে নবান্নের পুজো হত। অনেক গ্রামে অন্নপূর্ণা মূর্তি হত। পুজোর পর খাওয়া হত চালের প্রসাদ। সঙ্গে কলা, নাড়ু মিষ্টি- একদম পেটপুরে।

এরপর দুপুরের খাওয়া। বীরভূম জেলার রান্না খুব ভালো না হলেও পরিমাণ প্রচুর। দুপুরে হত নুতন চালের আঠা আঠা ভাত, সীম, বেগুন, নারকেল, আখ, বিউলির ডালের বড়া – মানে পাঁচ রকম ভাজা, পালংশাক, ফুলকপির তরকারি, বিউলির ডাল, মাছের ঝোল ,পায়েস এবং অতি অবশ্যই তেতুলের টক।

নবান্নের পরদিন হয় পান্ত নবান বা বাসি নবান। সেদিন হয় খাসির মাংস। আগে গ্রামে এত খাসির মাংস পাওয়া যেত না। তাই কয়েকবাড়ি মিলে কেটে ফেলত খাসি। একটু আধটু মদ্যপানও হত। কেউ কেউ বলত- পান্ত নবাবের মজা বেশি। এসব খাবার পর পেট খারাপও হত অনেকের।
আজ গ্রামের সেই অবস্থা আর নেই। সারাবছর চাষ আর অন্যান্য কাজের জন্য সেই অভাব আর নেই। দুর্গাপূজার দাপট এখন বেশি- সব গ্রামেই বেশ কয়েকটি করে বারোয়ারি পুজো। তবুও এর মাঝেই নবান্ন আছে।