লেনিনের সমর্থনে আফগানিস্তানেই হয় ভারতের প্রথম ‘বিপ্লবী সরকার’

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: সে ছিল এক মারকাটারি ব্যাপার। ব্রিটিশ ভীত। আফগানিস্তানের আমীর উল্লসিত। সোভিয়েত দিচ্ছে সমর্থন। সবমিলে ১৯১৫ সালে ভারতীয় বিপ্লবীরা আফগানিস্তানের রাজধানীতে যে প্রবাসী সরকার…

indian provincial government was founded in kabul

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: সে ছিল এক মারকাটারি ব্যাপার। ব্রিটিশ ভীত। আফগানিস্তানের আমীর উল্লসিত। সোভিয়েত দিচ্ছে সমর্থন। সবমিলে ১৯১৫ সালে ভারতীয় বিপ্লবীরা আফগানিস্তানের রাজধানীতে যে প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন তার সম্পর্কে বিস্তর লিখেছেন কমিউনিস্ট বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। ‘My Life Story’ আত্মজীবনীমূলক বইতে লিখেছেন সেই সরকারের প্রধান রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ।

আফগানিস্তান এখন তালিবান শাসনাধীন। গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারকে উপড়ে ফেলে দেশটিতে দ্বিতীয়বার ক্ষমতা দখল করেছে তালিবান। এই জঙ্গি সরকার কায়েম হওয়ার পিছনে কূটনৈতিক জলঘোলা প্রবল। একপ্রকার তালিবান হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে আফগানিস্তানের শাসন। নির্বাসিত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি।

তবে আফগানিস্তান নিয়ে কূটনৈতিক পাশা খেলা বহু পুরনো। এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে বারবার বিভিন্ন দেশ, রাজতন্ত্র শক্তি আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসে এশিয়ার বুকে নিজেদের ভিত শক্ত করতে চেয়েছে। আধুনিক ইতিহাসের তিন শক্তি ব্রিটিশ, সোভিয়েত ও আমেরিকা এসেছে-গেছে। আফগানিস্তানের গৃহবিবাদের মঞ্চ ঘিরে জন্ম নিয়েছে কূটনৈতিক খেলা।

ব্রিটিশ শাসনে থাকা ভারতের বিপ্লবীরা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট সরকারের মদতে বারবার সশস্ত্র পথ নিয়েছিলেন। এতে জড়িয়েছিল দারুল উলুম দেওবন্দের ধর্মীয় শিক্ষার্থীরা। আফগানিস্তানের মাটিতে ব্রিটিশ বিরোধী গোষ্ঠী প্রত্যক্ষ মদত পায়। তৈরি হয় ভারতের বাইরে বিপ্লবীদের নেতৃত্বে প্রথম প্রবাসী ভারত সরকার।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝেই ভারত থেকে আফগানিস্তান হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যাওয়া বিপ্লবীদের নেতৃত্বে তৈরি প্রবাসী ভারত সরকার বেশিদিন চলে। তবে এই সরকার ব্রিটিশ শক্তির কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় কাবুলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় প্রবাসী সরকার। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য এই সরকার আফগানিস্তানের আমীর (শাসক), জার্মানির ভারতীয় বিপ্লবী কমিটি (জার্মান কমিটি), তুরস্ক ও প্রথম দিতে রাশিয়ার জার রাজ পরিবারের সমর্থন পায়। ১৯১৭ সালে জারতন্ত্র উচ্ছেদ করে সোভিয়েত তৈরি হলে, সেই সরকারের প্রধান লেনিন সরাসরি কাবুলের এই প্রবাসী ভারতীয় সরকারকে সমর্থন করেন। সোভিয়েত সমর্থন পায় বিপ্লবীদের সরকার।

এক নজরে প্রবাসী বিপ্লবীদের পরিচালিত সরকারের মন্ত্রিপরিষদ:
১. রাষ্ট্রপতি বিপ্লবী রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ
২. প্রধানমন্ত্রী মাওলানা বরকতউল্লাহ
৩. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উবায়দুল্লাহ সিন্ধি
৪. বিদেশমন্ত্রীর চম্পকরমন পিল্লাই
৫. যুদ্ধমন্ত্রী মৌলবি বশির

এই বিপ্লবী সরকার বা প্রবাসী ভারতীয় সরকারের কথা বিপ্লবী এম এন রায়ের লেখা, বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বিভিন্ন রচনায় এসেছে। তাঁরাও এই সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রবাসী ভারতীয় সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিপ্লবী রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ আফগানিস্তান থেকে ব্রিটিশ শাসনে থাকা ভারতের দিকে সেনা অভিযানের পরিকল্পনা করেন।

কাবুল থেকে গুপ্তচরদের পাঠানো সংবাদে ভীত ছিল ব্রিটেন। ফলে তারা আফগানিস্তানের উপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে থাকে। ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের আমীরের সঙ্গে তিনটি যুদ্ধ হয় ব্রিটিশদের। ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ নামে এটি পরিচিত। ১৯১৯ সালে তৃতীয় যুদ্ধের পর আফগানিস্তান স্বাধীন হয়। তবে আফগান আমীর হাবিবুল্লাহ খানের উপর চাপ তৈরি করা হয় যাতে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের সরকার চলতে না পারে।

আফগান আমীর হাবিবুল্লাহ ছিলেন ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি চাপের মুখে সরাসরি কোনও সমর্থন না করলেও গোপনে প্রভূত সাহায্য করেন। তবে ১৯১৯ সালের পর কাবুলে ভারতীয় বিপ্লবীদের এই সরকার আর স্থায়ী হয়নি। যে সব বিপ্লবীরা, দেওবন্দের শিক্ষার্থিরা আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন তাঁরা সোভিয়েতমুখী হতে থাকেন। অনেকে দেশে ফিরে গোপনে ব্রিটিশ বিরোধী কাজ শুরু করেন। ধরা পড়েন।

কাবুলের সেই বিপ্লবী সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট সরকার। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র ও সংগঠিক শ্রমিক কৃষক বিদ্রোহের জন্য সোভিয়েত প্রধান লেনিন সরাসরি বার্তা পাঠান। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রপ্রধানের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই বার্তায় দেশের অভ্যন্তরে বিপ্লবীদের মধ্যে চাঞ্চল্য ফেলে দেয়। যার ফল ভারতের মাটিতে দুটি ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। একটি কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৪) ও দ্বিতীয়টি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯)।

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর কাবুলের প্রবাসী ভারতীয় সরকারের রাষ্ট্রপতি বিপ্লবী রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ কানপুর থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। ১৯৫৭ সালের লোকসভা নির্বাতনে কমিউনিস্ট নেতা, নির্দল প্রার্থী মহেন্দ্রপ্রতাপের কাছেই মথুরা কেন্দ্রে পরাজিত হয়েছিলেন ভারতীয় জনসংঘ প্রার্থী অটলবিহারী বাজপেয়ী।