Debasmita Nath: প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে জীবনের জয়গান গাইছেন দেবস্মিতা

“আমি ভয় করব না , ভয় করব না/ দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না” …. কবিগুরুর এই লাইনদুটিকে আত্মস্থ করেছিল মেয়েটি। তারপর ঝাঁপিয়ে…

Debasmita Nath

“আমি ভয় করব না , ভয় করব না/ দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না” ….
কবিগুরুর এই লাইনদুটিকে আত্মস্থ করেছিল মেয়েটি। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জীবনযুদ্ধে। আর তথাকথিত সমাজের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে প্রমাণ করে দিয়েছিল প্রতিভা কখনো প্রতিবন্ধকতায় আটকে থাকে না। এই কন্যার নাম দেবস্মিতা নাথ। (Debasmita Nath) তার জীবনকাহিনী আপনার আমার মতো সাধারন ঘরের এক মেয়ের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প।

ভালভাবে হাটতে পারেনা সে । এমনকি, ভালভাবে বসতেও পারে না । কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তার কন্ঠের জাদুতে আপনি মুগ্ধ হলেও বিশ্বাস করতে পারবেন না এক সময় ভালভাবে কথাই বলতে পারতো না মেয়েটি ।

২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরে দেবস্মিতার জন্ম হয় । যেভাবে আর পাঁচ টা বাচ্চা স্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে ওঠে ঠিক সেভাবে ওর বেড়ে ওঠা হয়নি। ছয় মাস বয়সে যখন অন্য বাচ্চারা হামাগুড়ি দিতে শুরু করে তখন হঠাৎ করেই তার পরিবারের লোকেদের নজরে আসে, ও ঠিক মত বসতেই পারছেনা। চার দিকে বালিশ দিয়ে ওকে বসাতে হতো, সব সময় মুখ দিয়ে লালা পড়তো। সন্তানের মধ্যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করতেই ওকে ডাক্তার দেখানোর পালা শুরু ।

প্রাথমিক অবস্থায় শিশু বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ আশা দেখাতে পারেননি কেউই। তবে, কিছুদিন পর ভেলোর থেকে আসা একজন নিউরো সার্জেন ওকে দেখে কিঞ্চিত স্বস্তির বাণী শুনিয়েছিলেন। বিশিষ্ট নিউরো সার্জেন বলেছিলেন, ‘সম্পূর্ণ না হলেও ওকে সময় দিলে অনেক টা ঠিক করা সম্ভব। তবে, প্রয়োজন বাড়িতে রেখে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি আর সেই সঙ্গে প্রচুর কথা বলতে হবে ,গান, কবিতা শোনাতে হবে।’

সন্তানকে নিয়ে শুরু হওয়া এই ভয়ঙ্কর জীবনযুদ্ধে সামান্য সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভবনা দেখতে পেয়েই তিন বছর বয়সে ওকে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেয় তার বাবা মা। আশা একটাই, যাতে বন্ধুদের দেখে কিছু শিখতে পারে। স্কুল থেকে আসার পর শুরু হতো ঘরে কথা বলানোর চেষ্টা। হাতেও অসুবিধে ছিল ,সবসময় হাত মুঠো করে রাখার জন্য লিখতে ও আঁকতে অসুবিধে হতো। সেটাকে ঠিক করার জন্য লেখা শেখানো হতো ঘরে আর ঘরে অঙ্কন প্রশিক্ষক রাখা হলো । ও প্রথম কথা বললো সাড়ে তিন বছর বয়সে । প্রথম বাবা, মামা ,তারপর মা বলেছিলো ۔ তারপর ছোট ছোট শব্দ , তারপর কথা ও সবশেষ কবিতা ।

সাড়ে তিন বছর বয়সে যে মেয়ে প্রথম কথা বলতে শেখে সেই মেয়েই মাত্র পাঁচ বছর বয়সে কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ কবিতা বলে ‘দ্বিতীয় পুরস্কার’ অর্জন করে। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কবিতার প্রতি ওর আকর্ষণ তৈরি হতেই দেবস্মিতার মা-বাবা তার আবৃত্তি চর্চার জন্য একজন প্রশিক্ষক রাখেন। তিনি হলেন শম্পা রায় চৌধুরী। তার পর শুরু হয় আবৃত্তি প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন প্রতিযোগীতা তে দেবস্মিতার অংশ নেওয়া । একটা সময় এমন হয় যে , কোনো প্রতিযোগীতা থেকে খালি হাতে সে ফিরতো না ।

কিন্তু একটা ব্যাপার বাড়ির লোকের নজরে আসে। তার মায়ের কথায়, “যতদিন ও স্কুলে করুনার পাত্রী হয়ে ছিল ততদিন সব ঠিক ছিল ۔কিন্তু যখন থেকে কবিতার থেকে ওর একটা পরিচিতি হতে শুরু করল তখন থেকে ওর কোনো স্কুল এ ব্যাপার টা ভালো ভাবে নিতে পারতোনা । হয়ত ঈর্ষা কাজ করতো এত দুর্বল একটা মেয়ে কিভাবে এত তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে যাচ্ছে যে যে স্কুলে ও পড়েছে সব গুলোতে এই এক অবস্থা। ভর্তি হওয়ার পর সব ঠিক থাকে থাকে কিন্তু কবিতার ব্যাপার টা জানা জানি হলেই নানা রকম মানসিক অত্যাচার শুরু হয়ে যেত । ঠিক এই কারণে ওকে অনেক স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল।”

জীবনযুদ্ধ কখনো সহজ ছিলনা মেয়েটির জন্য। যাই হোক এইভাবে দিন চলছিল । আর অল্প সময়ের মধ্যেই লোকাল টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠান করা থেকে দুর্গাপুজোর সময় বিভিন্ন মঞ্চ ও রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী তে অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দূর্গাপুরে নিজের একটা পরিচিতি পেতে শুরু করে সে। ঠিক ১৩ বছর বয়সে সে দুর্গাপুরে ব্রততী বন্দোপাধ্যায়ের কাছে কর্মশালায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। তারপর নরেশ নন্দীর কর্মশালা। তারপর ব্রততী পরম্পরা থেকে সরাসরি কাব্যায়নে শুরু আবৃত্তিচর্চা। সেখানে বিশিষ্ট শিল্পীদের সান্নিধ্য পায় সে।

এরপরেই মফস্বল পেরিয়ে দেবস্মিতা পা রাখে কলকাতার মাটিতে। তাই ওর যখন ১৭ বছর বয়সে ওর প্রথম সিডি বানানোর কথা শুরু হয় । বেশ কিছু সিডি কোম্পানীর সাথে কথা হয়। অনেক কোম্পানী ‘বসে বসে সিডি করা যায়না’ জাতীয় মন্তব্য করলেও এগিয়ে আসে কলকাতার ভাবনা রেকর্ডস। ১৮ বছর বয়সে ১ জুলাই ২০১৯ ,কোলকাতা প্রেস ক্লাব এ আনুষ্ঠানিক ভাবে সিডি প্রকাশ হয় । দেবস্মিতা প্রথম কলকাতা তে অনুষ্ঠান করে সুজাতা সদনে। তারপর রবীন্দ্র সদন ,বিড়লা একাডেমী , শিশির মঞ্চ, ত্রিগুনাসেন মঞ্চ , রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবন , বাংলা একাডেমী সহ আরো অনেক মঞ্চে সে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে।

বর্তমানে অবশ্য দুর্গাপুর থেকে প্রায় ই কোলকাতা আসা যাওয়া লেগেই থাকে অনুষ্ঠানের সূত্র ধরে। শুধু কলকাতা নয়, তার আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় তার অনুষ্ঠান থাকে। কলকাতার 91.9 Friends fm ۔ এ চলতেই থাকে তার অনুষ্ঠান৷

এই ভাবে ধীরে ধীরে ওর পথ চলা শুরু হয়। ১৮ বছর বয়সে মনন সাহিত্য পত্রিকা র পক্ষ থেকে দেবস্মিতা কে সম্মানিত করা হয় । ওই ১৮ বছর বয়সে পঞ্চম বর্ষ বঙ্গ প্রমীলা কৃতী রত্ন সম্মান ২০২০ সম্মানিত হয়। আগে আবৃত্তি নেশা ছিল এখন সেটা পেশাও । অনেক বাচ্চা আজ দেবস্মিতার কাছে আবৃত্তি শিখছে। আর শিল্পের হাত ধরেই দেবস্মিতা সমৃদ্ধ করছে নিজেকে, সমগ্র বাচিকশিল্পকে।