মিশর সম্রাজ্ঞী নেফারতিতির প্রিয় সমুদ্রের রেশম, এখন মাত্র একজন কারিগর

রেশমি সুতো তৈরি হয় রেশম পোকার গুটি থেকে। তবে পৃথিবীতে আরেক ধরনের রেশমি ‌সুতোর অস্তিত্ব রয়েছে। যার মূল উপাদান অর্থাৎ রেশম তন্তু পাওয়া যায় এক…

রেশমি সুতো তৈরি হয় রেশম পোকার গুটি থেকে। তবে পৃথিবীতে আরেক ধরনের রেশমি ‌সুতোর অস্তিত্ব রয়েছে। যার মূল উপাদান অর্থাৎ রেশম তন্তু পাওয়া যায় এক ধরনের সামুদ্রিক ঝিনুকের খোলস থেকে। সি সিল্ক বা সামুদ্রিক রেশম নামে সেই সুতো পৃথিবীর বিরলতম তন্তু। বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে কেবলমাত্র একজন কারিগরি রয়েছেন যিনি অসম্ভব পরিশ্রম করে তৈরি করেন সামুদ্রিক রেশম। মানুষটির নাম কিয়ারা ভিগো।

সামুদ্রিক রেশম এতটাই দুষ্প্রাপ্য যে এর পৃথিবীতে যে অস্তিত্ব রয়েছে সেটাই অনেকে বিশ্বাস করতে চায়না। কিন্তু কিয়ারা ভিগোর কল্যাণে আজও পৃথিবীতে টিকে আছে সামুদ্রিক রেশমের অস্তিত্ব। চুলের চেয়েও তিন গুণ সূক্ষ্ম, তুলোর মতো হালকা, বাদামী রঙের সামুদ্রিক রেশমের তন্তুগুলোর দেখা মেলে ইতালির সার্দিনীয়া দ্বীপে। ঝিনুক থেকে সামুদ্রিক রেশমের তন্তু পাওয়া যায় তার নাম পিনানবিলীশ বা পেন শেল। এগুলি পাওয়া যায় ভূমধ্যসাগরে। এই ঝিনুকগুলোর আকৃতি বিশাল, এক একটির দৈর্ঘ্য এক গজের ওপরে। ঝিনুকগুলোর শক্ত খোলস ঢাকা থাকে পাইসাস নামক একপ্রকার সূক্ষ্ম তন্তু দ্বারা। এই তন্তু থেকেই তৈরী হয় সামুদ্রিক রেশম।

   

৬৫ বছর বয়সী কিয়ারা ভিগো সার্দিনীয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রের গভীরে সাঁতরে বেড়ান। সেখানে জলের গভীরে লুকিয়ে আছে কিছু গোপন গুহা। যেখানে দেখা মেলে পেন শেলের। সূক্ষ্ম বাইসাস তন্তুগুলো লম্বায় ছ ইঞ্চি হয়ে থাকে। কিয়ারা ভিগো বলেন সামুদ্রিক রেশম প্রস্তুতি প্রণালী একমাত্র তিনি জানেন। কিন্তু ব্রিটিশ মেরিন বায়োলজিস্ট হেলেন স্কেলের লেখা একটি বইয়ে দাবি করা হয় কিয়ারা ভিগোর কথা পুরোপুরি সত্য নয়।

১৯৫০ সালের দিকে সেন্ট অ্যান্তিয়িগোতে সামুদ্রিক রেশম উৎপাদিত হত। তবে পিনা এবং অ্যসেলটিনা নামক দুই বোন আরও দু একজন রেশম উৎপাদন পদ্ধতি জানলেও নানা সমস্যার কারণে কেউই বর্তমানে সামুদ্রিক রেশম উৎপাদন করেন না। তাই কিয়ারা ভিগোই যে শুধুমাত্র সামুদ্রিক রেশম প্রস্তুত প্রণালী জানেন এ কথা সত্যি না হলেও তিনি বর্তমানে সামুদ্রিক রেশমের একমাত্র প্রস্ততকারক।

কিয়ারা ভিগো বলেন, সামুদ্রিক রেশম তৈরি তার পরিবারের হাজার বছর পুরোনো ঐতিহ্য। গবেষকদের মতে, সতেরোশো বছর আগে পর্যন্ত সামুদ্রিক রেশমের ইতিহাস জানা যায়। প্রাচীনকালে ল্যাটিন ভাষায় পাইসাস বলতে লিনেন এবং সামুদ্রিক রেশম দুধরনের তন্তুকেই বোঝাত। একারণেই গবেষকদের কাছে ইতিহাসের অনেক লিখিতবাণী ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে গেছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রাচীন মিশরীয় মমি যে কাপড় দিয়ে মোড়ানো হত সেটা অনেকসময় পাইসাসের তন্তু দিয়ে তৈরি হত। মিশরীয় রানী নেভার তিতি পড়তেন পাইসাসের তৈরি বাহুবন্ধনী। মেসোপটেমিয়ার রাজাদের কাপড়ে কাজ হত পাইসাস দিয়ে‌। কিন্তু সেই পাইসাস কি অসাধারণ কোনো‌ রেশম তন্তু না অনন্য সাধারণ সামুদ্রিক রেশম তা ইতিহাসবিদরা ব্যাখ্যা করতে পারেনি। একটি পুরো পোশাক বানাতে যতটা সামুদ্রিক রেশম সুতোর দরকার তা তৈরি করতে প্রচুর শ্রম ও সময়ের প্রয়োজন। যা কিয়ারা ভিগোর একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি সামুদ্রিক রেশমের পোশাক না বানিয়ে কেবল কাপড়ের নকশা করতে ব্যবহার করেন। তিনি কখনও এই সুতো বিক্রি করেননি। কাপড়ে কারুকার্য করে তিনি তা প্রিয়জনদের উপহার দিয়ে থাকেন।

একবার এক জাপানি ব্যবসায়ী তার কাপড়ে নকশা এঁকে নিতে চেয়েছিলেন কিয়ারা ভিগোর কাছে‌। বিনিময়ে তিনি দিতে চেয়েছিলেন ২.৯৯ মিলিয়ন ডলার তবু ভদ্রমহিলা বিক্রি করতে রাজি হননি। সামুদ্রিক রেশমের একমাত্র কারিগর কিয়ারা ভিগোর পরে এর ভবিষ্যৎ কী হবে কেউ বলতে পারেনা। ভদ্রমহিলার মেয়ে ম্যাডেলিনা যদি পরিবারের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে বেঁচে থাকবে সামুদ্রিক রেশম নয়ত কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে চিরতরে‌।