Birla House: গান্ধী হত্যা ও বিড়লা হাউস– ফিরে দেখা

দিল্লিতে অবস্থিত গান্ধী স্মৃতি নামে যে মিউজিয়ামটি গড়ে উঠেছে সেটি এক সময় ছিল বিড়লা হাউস (Birla House)৷ এই ভবনেই জাতির জনক নিহত হন৷বাপুর মৃত্যুর পর…

Gandhi Smriti museum Birla House
Siddhartha Mukhopadhyay
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
লেখক ও সাংবাদিক

দিল্লিতে অবস্থিত গান্ধী স্মৃতি নামে যে মিউজিয়ামটি গড়ে উঠেছে সেটি এক সময় ছিল বিড়লা হাউস (Birla House)৷ এই ভবনেই জাতির জনক নিহত হন৷বাপুর মৃত্যুর পর বিড়লা পরিবারের ওই বাড়িটিতে গান্ধীর স্মৃতিতে সংগ্রহশালা গড়তে গেলে চরম আপত্তি তুলেছিলেন মহাত্মার একান্ত অনুগত বলে পরিচিত ঘনশ্যামদাস বিড়লা৷
১৯১৬ সালে প্রথম গান্ধীজির সংস্পর্শে আসেন ঘনশ্যামদাস বিড়লা ৷ বয়েসের অনেকটা পার্থক্য থাকলেও এই দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যকার সম্পর্কটা এমন জায়গায় গিয়েছিল যে উভয়ের সিদ্ধান্তে তার প্রতিফলন ঘটত৷ নিবিড় সম্পর্কের জন্য অর্থ বা অন্য যে কোনও প্রয়োজনে বিড়লার কাছে সহায়তা চাইতে কুন্ঠাবোধ করতেন না বাপু৷ আবার পরাধীন ভারতে অনেক ব্যাপারেই গান্ধীজি জিডি বিড়লাকে গুরুদায়িত্ব দিতে চেয়েছেন যেটা কখনওবা এক্তিয়ার ছাড়িয়েছে বলে প্রশ্নও উঠেছে৷

স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনে বহু সময়েই গান্ধীজি থেকেছেন বিড়লাদের বিভিন্ন বাড়িতে৷ থাকাকালীন সেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরও আনাগোনা বাড়ত৷ চলত বৈঠক, আলাপ-আলোচনা৷ ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কর্মসূচি গান্ধীজি গ্রহণ করেছিলেন বম্বের বিড়লা হাউসে বসেই৷ যদিও তখন ঘনশ্যামদাস বিড়লাকে ডেকে বাপুজি জানিয়েছিলেন, তিনি এবার একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন, যার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ বিড়লাদেরও হয়রান করতে পারে৷সেজন্য তিনি অন্যত্র গিয়ে এই আন্দোলন শুরুর কথা ভেবেওছিলেন৷যদিও সব শুনে বিড়লা জানিয়ে দিয়েছিলেন- তিনি চান এই বাড়িতে থেকেই বাপু তাঁর আন্দোলনের কাজ শুরু করুক৷

আবার স্বাধীনতার পরে দিল্লিতে বিড়লা হাউসে গান্ধীজি আসেন ১৯৪৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর৷ সেদিন থেকে জাতির জনক জীবনের শেষ ১৪৪টি দিন কাটিয়েছিলেন ওই বাড়িটিতেই৷ ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বিড়লা পরিবারের ওই বাসভবন চত্বরেই প্রার্থনা করতে গেলে নাথুরাম গডসে-র গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল মহাত্মার৷

১৯২৮ সালে ১২ শয্যা বিশিষ্ট দিল্লির ওই বাড়িটি গড়েছিলেন শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লা৷ গান্ধীজির নিয়মিত যাতায়াতে এই বিড়লা হাউস যেন হয়ে উঠেছিল তাঁর নিজের বাড়ি ৷ শুধু গান্ধীজিকে ঘিরে সেই সময় আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাদের আসা যাওয়া ছিল ওই ভবনে৷ স্বাভাবিক ভাবেই গান্ধীজির মৃত্যুর পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু চেয়েছিলেন বাপুর স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটিকে সরকার অধিগ্রহণ করে জাতীয় সৌধ রূপে গড়ে তুলতে ৷ কিন্তু তখন এমন প্রস্তাবের কথা শুনে তাতে বাদ সেধেছিলেন গান্ধী ভক্ত বলে পরিচিত বিড়লা গোষ্ঠীর কর্তা ঘনশ্যামদাস বিড়লা৷ তিনি রাজি ছিলেন না গান্ধী স্মৃতিতে বাড়িটি হস্তান্তর করতে৷ ফলে এ নিয়ে বেশ মতবিরোধ দেখা গিয়েছিল জিডি বিড়লার সঙ্গে নেহরুর৷ ওই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি বিড়লাদের৷ জবাবে জিডি বিড়লা নেহরুকে লিখেছিলেন- এই বাড়ি তাঁর কাছে যেন একটা স্মৃতির ভাণ্ডার যা একটি বইয়ের মতো হয়ে রয়েছে যা স্মরণ করে তিনি গভীরভাবে তৃপ্ত হন৷

এরপরে সরকারের পক্ষ থেকে তখন পরামর্শ ছিল যেখানে মহাত্মা নিহত হয়েছিলেন ভবনের সেই অংশটি গান্ধীজির স্মৃতিতে হস্তান্তর করা হোক৷কিন্তু তখন সেটাও মানতে রাজি হননি জিডি বিড়লা৷ তিনি জবাবে জানিয়েছিলেন- এটা যেন কাউকে বলা হচ্ছে সন্তানকে কেটে দু’ ভাগ করে একটি অংশ রেখে দিয়ে অন্য অংশ দিয়ে দিতে বলা৷

ওই সময় নেহরু ওখানে বাপুর স্মৃতিতে কিছু করতে চেয়েছিলেন কারণ কংগ্রেসের অন্দরের লোকজন তথা দেশের বহু লোক তেমনটাই চাইছিল৷ ফলে ওই জায়গাটা দেওয়ার জন্য বিড়লা পরিবারের উপর অনবরত চাপ আসতে থাকে৷ যদিও সেই সময় বল্লভভাই প্যাটেল এইভাবে বাড়িটিকে অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেন৷ প্যাটেলের মনে হয়েছিল- এমন ভাবে মালিকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওই ভবনটি অধিগ্রহণ করে স্মৃতি সৌধ বানানোটা খোদ গান্ধীজিও মেনে নিতে পারতেন না।

এর কিছুদিন পরে প্যাটেলের মৃত্যু হয়৷তারপরে সময়ের তালে একে একে প্রধানমন্ত্রীরও পরিবর্তন হয়৷ জওহরলাল নেহরুর জমানা শেষ হয়ে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সময় পেরিয়ে শুরু হয় ইন্দিরা গান্ধীর জমানা৷যদিও এই বিষয়টির নিস্পত্তি তখনও হয়নি, একটা টানাপোড়েন চলছিল৷এদিকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাজনীতির আঙিনায় পায়ের তলায় মাটি শক্ত করতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী রাশিয়া এবং বামেদের দিকে ঝোঁকেন৷ সেইমতো অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করে নেমে পড়েন রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দিকে৷ প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম আলোচিত দিকটি হল ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ৷ যেখানে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় দেশিয় ব্যাঙ্ক গড়ার ভাবনা চিন্তা থেকেই জিডি বিড়লা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক (যা পরে ইউকো ব্যাংক বলেই পরিচিত হয়) গড়ে তোলেন, সেখানে বিড়লা গোষ্ঠীর এই সংস্থাটি ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের জন্য তাঁদের হাত থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়৷

সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে অন্যান্য কংগ্রেস বন্ধু শিল্পপতিদের পাশাপাশি বিড়লাদের সঙ্গেও ইন্দিরার সম্পর্কের অবনতি ঘটে৷ আবার ওই সময় কোনও শিল্পগোষ্ঠীর একচেটিয়া ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে উদ্যোগী হয় সরকার৷ সেই সময় ‘তরুন তুর্কী’ বলে পরিচিত চন্দ্রশেখর (যিনি পরবর্তী কালে প্রধানমন্ত্রী হন) বিড়লাদের বাণিজ্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, কর ফাঁকি সহ বেশ কিছু অভিযোগ নিয়ে সংসদে সরব হন ৷ এদিকে সিপিআই নেতা এস এ ডাঙ্গে ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর দিনটিকে ‘Anti Monopoly Anti Birla Day’ বলে ঘোষণা করেন৷ পাশাপাশি ডাঙ্গে হুমকি দেন, ছয় মাসের মধ্যে বিড়লাদের দিল্লির বাড়ি জনগণের হাতে তুলে না দিলে শ্রমিকরাই তা দখল করে নেবে৷বিড়লা হাউস-এ গান্ধী স্মৃতি সৌধ গড়ে তোলার বিতর্কিত বিষয়টি ফের রীতিমতো মাথাচারা দেয়৷

অবশেষে বিড়লাদের কাছ থেকে ওই বাড়িটি সরকার নেয় বিনিময়ে ৫৪ লক্ষ টাকা ও শহরে সাত একর জমি দেওয়া হয়৷ ১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর কিছুটা অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিল্লির বিড়লা হাউসকে গান্ধী সদনে পরিণত করতে তা তুলে দেওয়া হয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরির হাতে৷ তখন বিড়লা পরিবার এই বাড়ি ছেড়ে বসন্তকুঞ্জে একটি ভাড়া বাড়িতে বাস করতে থাকেন, যতদিন না পর্যন্ত অমৃতা শেরগিল মার্গে নতুন বাংলো ‘মঙ্গলম’ গড়ে ওঠে৷ কালের স্রোতে এই বিড়লা হাউসটি জাতীয় সৌধ হিসেবে গড়ে ওঠে ৷ নাম হয় গান্ধী স্মৃতি৷ ১৯৭৩ সালের ১৫ অগস্ট থেকে এই ভবনটি সাধারণের পরিদর্শনের জন্য খুলে দেওয়া হয়৷ সেখানে সংগৃহীত রাখা রয়েছে গান্ধীর জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত নানা সামগ্রী৷ ২০০৫ সালে এখানে গান্ধীজিকে ভিত্তি করে একটি মাল্টিমিডিয়া মিউজিয়ামের উদ্বোধন করা হয়৷