শুনলে অবাক হয়ে যাবেন এই খাবারগুলির বাঙালির পাতে আসার কাহিনী

Special Correspondent, Kolkata: বাঙ্গালিদের থালায় খাবার গুলো এলো কোথা থেকে? মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটা সত্ত্যি যে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যে খাবার আমরা খাই…

Bengalis food history

Special Correspondent, Kolkata: বাঙ্গালিদের থালায় খাবার গুলো এলো কোথা থেকে? মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটা সত্ত্যি যে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যে খাবার আমরা খাই তার এক বৃহৎ অংশ এসেছে বিদেশ থেকে। বিশেষ করে সব্জী ও ফল ।

এরা আমাদের এত পরিচিত ও বাঙ্গালিয়ানায় ভরপুর যে এদের নাম শুনলে অধিকাংশ বাঙ্গালি বা ভারতীয় বিশ্বাস করবে না বা গাজাখুরি তথ্য বলে ভাববে । এই মুহূর্তে আমাদের খাবারের থালায় থাকা খাদ্যের প্রায় ৬০-৭৫ শতাংশ খাদ্যবস্তু এসেছে ভারতের বাইরে থেকে, আর এনেছেন এদেশে বানিজ্য করতে আসা বনিকেরা।

প্রথমেই নাম করি যে বস্তুটির সেটা হলো আলু। প্রায় ৮০০০ -১০০০০ বছর আগে দক্ষিন আমেরিকার পেরুর রেড ইন্ডিয়ানরা আলুর চাষ শুরু করেছিল আন্দিজ পর্বতমালার ঢালে ও পাদদেশে । পনেরশ শতকে স্পানিশরা দক্ষিন ও মধ্য আমেরিকা থেকে আলু নিয়ে আসে ইয়োরোপে । ভারতে আলু প্রবেশ করে ১৭ শতকে পর্তুগীজ বনিক বা জলদস্যুদের মাধমে যারা এর সাথে পরিচিত হয়েছিল পাশের দেশ স্পেন থেকে । এই মুহূর্তে আলু পৃথিবীর চতুর্থ প্রধান খাদ্য – ভাত, গম, ভুট্টার পরে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫০০০ বিভিন্ন প্রজাতির আলু চাষ হয় এবং মানব প্রজাতির (বাঙ্গালিদের ত বটেই ) দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এর গুরুত্ব কি তা বলা নিষ্প্রয়োজন । আলু শুধু সুস্বাদুই নয় ,অন্যতম পুষ্টিকর ও ক্যালরি সমৃদ্ধ এক খাদ্যবস্তু। ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসকরা অনেকেই আলু আর ভাত নিষেধ করেন এবং রুটি খেতে বলেন। কিন্তু ১০০ গ্রাম আলু ও গমে ক্যালরির পরিমান যথাক্রমে ১৫৭৪ ও ১৫৩৩ কিলো কালরি এবং কার্বোহাইড্রেটের পরিমান ৮১ ও ৮২ গ্রাম । অর্থাৎ যিনি রুটি খান তিনি রুটির বদলে সম পরিমান আলু খেলে তার খাদ্যে সমান পরিমান কালরি ও কার্বোহাইড্রেট থাকার সম্ভবনা ( এই প্রসঙ্গে একটি কথা জরুরী – আলুর গ্লাইসেমিক্স ইন্ডেক্স গমের চেয়ে বেশি , এটা রক্তে সুগার বাড়াতে পারে)।

বিজ্ঞানীদের মত অনুযায়ী আন্টি অক্সিডেন্ট ( লাইকোপেন ) ও ভিটামিন সমৃদ্ধ সব্জীর মধ্যে অন্যতম হলো টমেটো । এই অতি পরিচিত সব্জীটি প্রথম চাষ শুরু করেছিলো দক্ষিন আমেরিকার আন্দিজ পর্বত মালার পেরু ও ইকুয়েডরের আদি রেড ইন্ডিয়ানরা ও মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো অঞ্চলের আজটেক সভ্যতার রেড ইন্ডিয়ান্ জাতির মানুষেরা। আজটেকদের এক প্রচলিত ভাষা ‘নাহুটি’ তে tomati , স্পানিশে পরিবর্তিত হয়ে হয় tomate , সেখান থেকে ইংরেজি ভাষায় এলো tomato । বলা বাহুল্য পর্তুগীজ বনিকদের হাত ধরেই এই পরিচিত ফল বা সব্জীটি আমাদের দেশে আসে। ১৬ শ শতাব্দীতে বম্বে বন্দরের আশেপাশে প্রথম টমাটোর চাষ শুরু হয়। আর টমাটো সস আমেরিকান দের আবিস্কার ।

পেঁপে , হ্যা ঘোর বাঙালি ও ভারতীয় ফল পেঁপে আমাদের দেশের ফলই নয়। উদ্ভিদবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে এরও আদি উৎপত্তি বা চাষ শুরু করেছিলো মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে রেড ইন্ডিয়ান জাতির মানুষেরা । সেখান থেকে স্পানিশ দের হাত ঘুরে ব্রিটিশ ও ডাচ ঔপনিবেশিকদের দ্বারা এই ফল পৌঁছায় কারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও মালয়েশিয়ায়। এরাই ১৫৫০ নাগাদ এই সুস্বাদু ফলকে নিয়ে আসে ভারতবর্ষে । ভারত থেকেই পেঁপে চীনে গিয়েছিল এবং ভারতেই বর্তমানে পেঁপের সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। প্রাচীন মেক্সিকোর রেড ইন্ডিয়ানরা জেনে ছিলো কাচা বা পাকা পেঁপে দিয়ে মাংস মারিনেট করে রাখলে বা সেদ্ধ করলে মাংস খুব তাড়াতাড়ি সুসিদ্ধ হয়। কয়েক হাজার বছর পর আমাদের রান্নার কড়াইয়ে আজও আমরা একই পদ্ধতি ব্যবহার করি। পেঁপে ভিটামিন সি, এ ও আন্টিওক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এক পরিচিত সুস্বাদু ফল , গ্রাম বাংলার প্রায় সব বাড়িতে দেখা যায় এই গাছ।

পিয়ারা মতো অতি পরিচিত ফলের উৎস সন্ধান করলেও বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এই ফলটি ও এসেছে আমেরিকা ভুখন্ড থেকে। এর আদিম বাসভুমি মেক্সিকো, মধ্য ও দক্ষিন আমেরিকার উত্তর অঞ্চল । পেরুতে ৪৫০০ বছর আগে পিয়ারার ফলন শুরু হয়েছিলো । ১৮শ শতকে পিয়ারার চাষ শুরু হয় উত্তর আমেরিকায়। ভারতে এই ফলটি নিয়ে আসে পর্তুগীজরা ১৭ শ শতকে ।

আমাদের খুব জনপ্রিয় ফল কলা। না, এটাও ভারতের নয়। কলার আদিমতম উৎস স্থল অস্ট্রেলেশিয়া মহাদেশের পাপুয়ানিউগিনি। নিউগিনির কুক সোয়াম্প অঞ্চলে যে ফাইটোলিথ পাওয়া গেছে তার থেকে জানা যায় প্রায় ৮০০০- ১০০০০ বছর আগে পাপুয়ানিউগিনিতে কলা ফলতো। এখান থেকে ফলটি আসে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়, মালয় উপদ্বীপে এবং মালয় উপসাগরের ও ভারত মহাসাগরের বানিজ্য পথ ধরে অস্ট্রোনেসিয়ান বনিকদের মাধ্যমে কলার প্রসার ঘটে দক্ষিন এশিয়া, ভারত উপমহাদেশ, আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া ও এশিয়ার অনান্য অংশে। পাকিস্তানের কোট দিজিতে খনন করে যে ফাইটোলিথ পাওয়া গেছে তা সিন্ধু সভ্যতায় প্রায় ৫৩০০ বছর আগে কলার উপস্থিতি প্রমান করে। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বে কলার সরবাধিক উৎপাদনকারী দুটি দেশ হলো ভারত ও চীন (৪০%)।

ঝিঙে ( Sponge gourd ) সব্জীটির আদি উৎপত্তি দক্ষিন ও মধ্য আমেরিকায় । স্পানিশরা এটাকে নিয়ে যায় আফ্রিকায় । মিশর থেকে ঝিঙ্গে ইয়োরোপে প্রবেশ করে ১৬ শতাব্দীতে এবং খুব সম্ভবত পর্তুগীজ বা ইংরেজ বনিকেরা এটাকে নিয়ে আসে ভারতে।

বাঁধাকপি ( cabbage) আমাদের দেশের সব্জী নয়। প্রায় তিন হাজার বছর আগে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে ও উত্তর পশ্চিম ইয়োরোপে এক ধরনের বন্য বাধাকপির চাষ শুরু হয়। ইয়োরোপ থেকে এই সব্জী আসে আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশে মুলত বনিক ও ঔপনিবেশিকদের হাত ধরে। ১৫ শ থেকে ১৭ শ শতাব্দীর মধ্যে এই উপনিবেশিকরাই ভারতবর্ষে বাঁধাকপির আবির্ভাব ঘটায় । ১৮শ শতকে বাঁধাকপি ভারত থেকে যায় জাপানে এদের হাত ধরেই।

বাঁধাকপির মতো ব্রাসিকা গ্রুপের আর একটি অতি সুস্বাদু ও বহুল পরিচিত সব্জী ফুলকপি ( cauliflower )। ফুলকপির চাষ ও ভক্ষন প্রথম শুরু করে ভূমধ্যসাগরের এক ছোট্ট দ্বীপ সাইপ্রাসের লোকেরা। ঐতিহাসিক প্লিনির লেখায় এর উল্লেখ আছে – গ্রীকরা এই সব্জী খাদ্য হিসাবে খুব পছন্দ করতো । ১২শ -১৩ শ শতকের আরব উদ্ভিদবিদ ইবন আল আজম ও ইবন আল বাতরের লেখায় পাওয়া তথ্য অনুসারে মধ্যযুগে সাইপ্রাস থেকেই এই আনাজ আরবে প্রচলিত হয়। কিন্তু অবাক করা তথ্য হলো তারপর আরব বনিকরা ও আরব আক্রমনকারীরা কিন্তু একে নিয়ে আসে নি ভারতের রান্নাঘরে। ভারতের মাটিতে ফুলকপির চাষ শুরু হয়েছে নাকি মাত্র ১৫০ বছর আগে। ডাঃ জেমসন ১৮২২ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফুলকপি নিয়ে আসেন ভারতের উত্তর প্রদেশে, এবং সাহারানপুরে নাকি প্রথম ভারতীয় ফুলকপির ফলন শুরু হয়।

বর্তমান ইরান ও আফগানিস্তানে প্রথম গাজরের ( carrot) চাষ শুরু হয়েছিল আজ থেকে অন্তত ছয় হাজার বছর আগে। প্রত্নতাত্বিক খননের ফলে সুইজারল্যান্ড ও জার্মানির বেশ কিছু জায়গায় ৪০০০-৫০০০ বছরের পুরানো গাজরের বীজ পাওয়া গেছে। ১ম শতকে রোমানদের লিপিবদ্ধ করা বিবরনে গাজরের উল্লেখ আছে। ৮ ম শতাব্দীতে আরব মুরদের দ্বারা গাজরের প্রবেশ ঘটে আইবেরিয়ান পেনিন্সুলায় – স্পেনে। প্রাচীন গাজরের রঙ ছিল বেগুনী । এখন যে গাজর আমরা খাই এই কমলা বর্ণের গাজরের চাষ শুরু হয়েছিল আফগানিস্তানেই দশম –একাদশ শতাব্দী নাগাদ।, ভারত ও এশিয়ার অনেক স্থানে দশম শতক নাগাদ যে গাজর ফলত তার রঙ ছিলো বেগুনী । ১১ শ -১২ শতকে ইস্রায়েল ও গাজা পালেস্টাইন অঞ্চলে লাল ও কমলা দুই প্রকারের গাজরের কথা পাওয়া যায় । আরব-আন্দালুস অঞ্চলের ইবন আল আজম ও ইবন আল বাতরের লেখায় একই কথা পাওয়া যায়। ১২ শ শতাব্দী নাগাদ চীনের নদী অববাহিকায় ও ১৬শ -১৭শ শতাব্দীর সময়ে জাপানের কৃষিক্ষেত্রে গাজর ফলতে শুরু করেছিল।

আনারস ( pine apple ) আমাদের দেশের ফল নয়। যতদূর জানা যায় ব্রাজিল ও পারাগুয়ের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া পারানা-পারাগুয়ে নদী অববাহিকায় প্রথম আনারসের চাষ শুরু করেছিলো সেখানকার রেড ইন্ডিয়ান জনজাতির মানুষরা । এখান থেকে এই ফল ছড়িয়ে পড়ে সারা দক্ষিন ও মধ্য আমেরিকায়। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-৮০০ অব্দের মধ্যে পেরুতে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২০০সাল নাগাদ মেক্সিকোতে এর ফলন শুরু করেছিলো ইনকা ও আজটেক রেড ইন্ডিয়ান সভ্যতার মানুষরা। সভ্য জগতের বা ইয়োরোপের মানুষদের মধ্যে কলম্বাসই প্রথম আনারসের সাথে পরিচিত হন ১৪৯৩এর ৪র্থ নভেম্বর যখন তিনি গুয়াদেলোপ দ্বীপে পৌছন । ১৫৫০ সাল নাগাদ পর্তুগীজ বনিকেরা আমাদের দেশে নিয়ে আসে আনারস। এবং ভারতের পশ্চিম উপকুল অঞ্চলে এর আবাদ শুরু হয়। স্পানিশরা একে বলত pina , পর্তুগীজ ভাষায় abacaxi , ডাচ ও ফরাসিরা ডাকত anas নামে। এই শব্দ গুলোই বিবর্তিত হয়ে আনারস বা pine-apple হয়েছে।

আলুর কথা আগেই বলেছি । এবার রাংগালুর কথা শুনুন। অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মতে প্রায় ৫০০০ বছর আগে মধ্য ও দক্ষিন আমেরিকার নিরক্ষীয় অঞ্চলে রাঙ্গালুর চাষ শুরু হয়েছিলো । প্রায় একই সময়ে ইউকাটান উপদ্বীপ ও মেক্সিকোর অনান্য স্থানে রাঙ্গালুর উপস্থিতির প্রমান পাওয়া যায় । এখান থেকেই এই মিষ্টি আলু পৌঁছয় উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে , কারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ও ইউরোপে । কলম্বাস ইউওরোপীয়দের সাথে নব আবিষ্কৃত ভুভাগ থেকে আনা যে সমস্ত নুতুন বস্তুর পরিচয় করিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিলো এই খাদ্যটিও । যদিও আধুনিক গবেষনা বলছে রাঙ্গালুর আদিমতম উৎস ভারতীয় উপমহাদেশ । আড়াই কোটি বছর আগেই গন্ডোয়ানা ভুভাগে মর্নিং গ্লোরি নামক উদ্ভিদ প্রজাতির উদ্ভব হয়। এই মনিং গ্লোরি পরিবারের মধ্যে পড়ে রাঙ্গালু । উত্তরপূর্ব ভারতের মেঘালয়ে ২৫ মিলিয়ন বছরের পুরানো মনিং গ্লোরির ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে।

আপেলের আদি জন্মভুমি মধ্য এশিয়া । তিয়ান সান পর্বতমালায় ৪০০০- ১০০০০ বছর আগে এর চাষ আরম্ভ হয় । তারপর রেশম পথ বেয়ে এই উত্তম উপাদেয় ফল পৌঁছয় পশ্চিম এশিয়ায়, ইয়োরোপে ও আমেরিকায়। স্যামুয়েল ইভান স্টোকস নামে এক আমেরিকান ১৯১৬ সালে হিমাচল প্রদেশের থানেদার নামক এক পাহাড়ি গ্রামে প্রথম ভারতের আপেল গাছটি রোপন করেন। আমেরিকার লুসিয়ানা থেকে রেড ডিলিসিয়াস ও গোল্ডেন ডিলিসিয়াস জাতের আপেল চারা নিয়ে এসে তিনিই প্রথম ভারতীয়দের আপেলের সাথে পরিচয় করান। ১৯২৬ সালে এই বাগানেই ফলে প্রথম ভারতীয় আপেল । ভারতপ্রেমী এই সাহেবের সম্বন্ধে আর একটি তথ্য হলো ইনি ভারতে এসেছিলেন কুষ্ঠ রোগীদের সেবায় জীবন অতিবাহিত করবেন বলে। স্টোকস হিন্দু ধর্ম গ্রহন করে সত্যানন্দ স্টোকস নাম নেন ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খাটেন।

বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য শষ্য গম । খৃস্টপূর্ব ৯৬০০ এর কাছাকাছি সিরিয়ায় ও দক্ষিণপূর্ব তুরস্কে প্রথম গমের চাষ আরম্ভ হয়। ৬৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই খাদ্য শষ্যের চাষ শুরু হয় গ্রীস , সাইপ্রাস ও ভারতীয় উপমহাদেশে ।
বিশ্বের তৃতীয় প্রধান খাদ্য শষ্য ভুট্টার প্রথম চাষ করেছিল মেক্সিকোর রেড ইন্ডিয়ানরা ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বালসাস নদী উপত্যকায় । এই শষ্য ৬০০০- ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশে পাশে পৌঁছায় কলম্বিয়ায় । ৬৭০০ আগে পেরু ও ৪৫০০ বছর আগে আমেরিকার প্রায় সমস্ত অঞ্চলে ভুট্টার ফলন শুরু হয়েছিল। এখন ভুট্টা আমেরিকার দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য শষ্য, গমের পরেই। ভারতে ভুট্টা নিয়ে আসে পর্তুগীজরা ১৭ শতক নাগাদ।

আজকে দুনিয়ার প্রায় সমস্ত রান্না ঘরে প্রস্তুত হওয়া খাবারে লঙ্কা এক অন্যতম উপাদান। সমগ্র এশিয়া, দক্ষিন ও মধ্য আমেরিকা , আফ্রিকা, দক্ষিন ইওরোপের মানুষ খাবারে ঝাল পছন্দ করে। খাদ্যে ঝাল আমাদের স্বাদ কোরককে উজ্জিবীত করে ও লালাগন্থি থেকে লালা নিঃসরন ঘটিয়ে খাদ্যকে স্বাদযুক্ত ও রুচিকর করে তোলে। ভারতে লঙ্কা আসার আগে রান্না করা খাদ্যে ঝাল স্বাদ আনার জন্য ব্যবহৃত হতো গোলমরিচ । গোলমরিচ প্রচুর উৎপাদিত হতো কেরালায় । প্রায় ৭৫০০ বছর ধরে লঙ্কার ব্যবহার হয়ে আসছে বলে জানা গেছে। মধ্য ও দক্ষিন আমেরিকার মানুষরা এর ব্যবহার শুরু করেছিল ৭৫০০ বছর আগেই। দক্ষিন আমেরিকার পেরু, বলিভিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির লঙ্কার উৎপাদন হতো সেই প্রাচীন কাল থেকেই। কলম্বাসই প্রথম এই বস্তুটিকে নিয়ে আসেন ইউরোপে । স্পেন , পর্তুগাল , দক্ষিন ইউরোপ ঘুরে এই লঙ্কা ভারতে ও এশিয়ার অনান্য স্থানে প্রবেশ করেছিলো ইউরোপীয় বনিকদের মাধমে। পনেরো শতকে ভারতে লঙ্কা নিয়ে আসেন পর্তুগীজ বনিকরা।

আর এক উপকারী মশলা মেথির সাথে ভারতের পরিচয় হয়েছিল বানিজ্যের সুত্রে। সুপ্রাচীন কাল থেকে মধ্য প্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া ও সুমেরীয়ায় মেথির ব্যবহার হতো। ইরাকের তেল হালাল নামক স্থানে খনন করে ৬০০০ বছরের পুরানো পোড়া মেথি পাওয়া গেছে।

ধনে /ধনেপাতা আর এক অত্যন্ত উপকারি রান্নার উপাদান। ধনে পাতায় আছে প্রভুত পরিমানে ভিটামিন কে , আন্টিওক্সিডেন্ট ও খনিজ পদার্থ । এর আসল উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক আছে। ধনের সব চেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক নমুনা পাওয়া গেছে ইস্রায়েলের নাহাল হেমার গুহায়, যা ৬০০০-৮০০০ বছরের পুরানো বলে প্রত্নতাত্বিকদের ধারনা। মিশরে তুতেনখামেনের সমাধিতে ধনের অস্তিত্ব প্রমান করে অতি প্রাচীন কালে উত্তর আফ্রিকায় ধনের চাষ ও ব্যবহার হতো । ইবেরাস পাপিরাসে পাওয়া ধনে পাতার উল্লেখও প্রমান করে আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মিশরে এর ব্যবহার হতো । প্রধানত পশ্চিম এশিয়া আফ্রিকা ও দক্ষিন ইয়োরোপে এর চাষ শুরু হয়েছিলো এবং অই অঞ্চলের সাথে ভারতের সুপ্রাচীন কাল থেকে ব্যবসা বানিজ্যের সম্পর্ক থাকায় প্রাচীন যুগেই এই মশালা আমাদের দেশে আসে।

এই প্রসঙ্গে বলি , আমাদের অতি পরিচিত আরও কয়েকটি সব্জী যেমন বেগুন, কচু, লাউ, কুমড়ো , শুক্তোর উপাদান নিম, করলা, উচ্ছে , নানা জাতের সীম ,বিন এবং ফলের মধ্যে আম – এদের আদি উৎপত্তি স্থল বা বাসভুমি এশিয়া , আফ্রিকা , ভারতীয় উপমহাদেশ । সে অর্থে এরা প্রকৃত ভারতীয় বা বাঙ্গালী খাবার।

এই তালিকা দীর্ঘ ও অজস্র ঐতিহাসিক সুত্রের উপস্থিতি এই নিবন্ধকে দীর্ঘতর করবে। ওপরের তথ্যগুলো থেকে এইটুকু ধারনা করা গেলো যে অধিকাংশ বাঙ্গালী ও ভারতীয় খাদ্যের উপকরন বিদেশ থেকে এসেছে ।

অনেক ফল ও সব্জী , আনাজ সারা মানব জাতিকে চিনিয়েছে মধ্য, দক্ষিন ও উত্তর আমেরিকার অর্ধসভ্য রেড ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীর মানুষেরা। যাদের ইউওরোপের শ্বেতাঙ্গরা বলতো অর্ধ সভ্য , অসভ্য , বন্য । এবং যাদের সম্পদ , বাসস্থান , চারন ভুমি , অরন্য, দেশ, প্রান সভ্য ইয়োরোপিয়ানরা কেড়ে নিয়ে এদের অস্তিত্বকে করে তুলেছিলো বিপন্ন , তারাই সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য রেখে গেছে খাদ্যের সম্ভার। আজকের সভ্য দুনিয়ায় আমাদের খাবারের টেবিলে, ফ্রীজে, বাজার ,রেস্ট্রুরেন্টে বা মলে যে বিপুল বৈচিত্র্যময় খাদ্য সাজানো থাকে তাদের মুল উপাদান এই বুনো লোক গুলোই প্রথম আবিস্কার করেছিল কয়েক সহস্র বছর আগে বিপদসংকুল অরন্য, পাহাড়, তৃণভূমিতে খুঁজে খুঁজে ।

আর একটি কথা না বললেই নয়। সারা পৃথিবীকে এত অজস্র খাদ্যের সাথে পরিচয় করিয়েছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বনিক, জলদস্যু , অভিযাত্রী , আক্রমণকারীরা। আমাদের দেশে অধিকাংশ ফল ও সব্জী এনেছেন পর্তুগীজ বনিকরা। ঔপনিবেশিকতা যেমন মানব সভ্যতার কালো অধ্যায় , তেমনি উপনিবেশিকরাই দুনিয়ার কোনে কোনে মানবজাতির কাছে নিয়ে গেছে নতুন নতুন খাদ্য, নব সংস্কৃতি, ভাষা , সারা পৃথিবীতে হয়ে চলা জ্ঞান, চিন্তা, বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কার। মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে এদের অবদানও অনস্বীকার্য ।