নীল চাষ এবং বিশাল বটবৃক্ষের ছায়ায় ওপার বাংলায় লুকিয়ে ৩০০ বছরের কালী মন্দির

Special Correspondent: ওপার বাংলা বিপর্যস্ত মৌলবাদে। ভাঙা হচ্ছে মন্দির, মূর্তি। এসব অস্থিরতার মাঝেই ৩০০ বছরের ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে সেখানেই। বাংলাদেশ ঢাকা বিভাগ নরসিংদী জেলার পুরাতন…

kalibari

Special Correspondent: ওপার বাংলা বিপর্যস্ত মৌলবাদে। ভাঙা হচ্ছে মন্দির, মূর্তি। এসব অস্থিরতার মাঝেই ৩০০ বছরের ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে সেখানেই।

বাংলাদেশ ঢাকা বিভাগ নরসিংদী জেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা হাড়িধোয়া নদীর দক্ষিণ তীরে সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে অবস্থিত এই মন্দির ছায়া সুনিবিড় নির্জন পরিবেশে গড়ে উঠেছে। কালীবাড়ীর মূল আকর্ষণ হচ্ছে প্রায় এক একর জমির উপর বেড়ে উঠা বিশালাকার বট বৃক্ষ। একসময় কালীবাড়ীর অদূরেই নীল কুঠি ছিল। বর্তমানে নীল কুঠির ভাঙ্গা ভিটা ও পরিত্যক্ত ইঁদারা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নীলকর জেমস ওয়াইজের দেওয়ান রামকৃষ্ণ রায় বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

আনুমানিক ১৭৬০ সালে এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। দ্বীজ রাম প্রসাদ নামী একজন বীর সাধক মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। কালীবাড়ী প্রতিষ্ঠাতা সাধক দ্বীজরাম প্রসাদ ‘চীন ক্রম’ নামের সাধন প্রণালীতে অভ্যস্ত ছিলেন। চীন ক্রম থেকেই চিনিশপুর গ্রামের নামকরণ হয়।

এই কালী বাড়িতে কোন প্রতিমা ছিল না, দেবালয়ের মধ্যভাগে একটি চতুস্কোন বেদী এবং বেদীর উপর কালিকা যন্ত্র আঁকা আর এই যন্ত্রেই দেবী মায়ের অধিষ্ঠান। যন্ত্রেই পূজা আরাধনা ভোগারতি প্রানের যত আকুতি মিনতি। কথিত আছে এই মন্দিরে কেউ থাকতে পারে না এবং ঐখানে নিশাকালে জপধ্যানে বসে কেউ জীবিত আসতে পারেনি ।চতুষ্সাধনায় সিদ্ব১০৮ শ্রী শ্রী নিগমানন্দ পরম হংস দেব তার চারজন অন্তরঙ্গ শিষ্য সহ উক্ত চিনিশপুর কালী দর্শনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন।কালী বাড়ীর সেবায়েৎ চন্দ্রকিশোর চক্রবর্তী পরমহংস দেবকে বললেন এখানে রাত্রি যাপন করলে কেউ জীবিত ফেরত আসেনা। নিগমানন্দ পরমহংস দেব এই বিষয়ে তোমার না ভাবলে চলবে বলে সুদূর প্রত্যয়ে জানালেন।

kalibari

মধ্য যামিনী, ঘোর অন্ধকার নীশি রজনিতে পরমহংসদেব ইটের তৈরী ছোট্ট ঐমন্দিরে প্রবেশ করলেন। তার চার অন্তরঙ্গ শিষ্যকে চার দিকে পাহারায় নিযুক্ত করলেন যাতে কেউ উকি ঝুকি দিতে নাপারে। কারণ মায়ের সহিত তার লীলা যে দেখবে সে আর প্রানে বাঁচবে না। মন্দিরে ঢুকেই ঠাকুর দরজার বন্ধ করে দিলেন। আসনে বসে একটু ধ্যানস্থ হতেই ঠাকুর কারও উপস্থিতি অনুভব করল। চোখ মেলে দেখেন ১২/১৩ বৎসরের একটি মেয়ে তার বাম পা ঝুলিয়ে ও ডান পা তার বাম উরুতে রেখে বসে আছে, মুক্ত কেশী পরমাসুন্দরী লালচেলী পরা। অনিন্দ্য রুপের ঝলকে মন্দির প্রকোষ্ট আলোকিত। ঠাকুর ঐতনয়া রুপা মাকে তার কোলে বসতে বললেন। বলার সাথে সাথে মা এসে ঠাকুরের কোলে বসলেন, তাদের মধ্যে অনেক গুহ্য বিষয়ে আলাপ হল। তারপর ঠাকুর মাকে বললেন আমি এই পর্যন্ত যাদের ভার নিয়েছি ওপরে নেব, সেই আগত অনাগত সবার ভার তোমাকেও নিতে হবে তখন মা হেসে বলল আমিত নিয়েই আছি।

চিনিশপুর কালীবাড়ীটিকে মায়ের লীলাক্ষেত্রও বলা হয়। এখানে মা তার ভক্তদের সাথে অনেক লীলা করেছেন। যেমন কালীবাড়ীর পুকুরে হাত দেখিয়ে তার ভক্তকে বলেছিলেন দেখ তোর শাঁখা আমি হাতে পরেছি।

যতীন্দ্র মোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্রী শ্রী চিনিশপুর কালিবাড়ীটির ইতিহাস জানা যায়। ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির কর্মকাণ্ড বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। তিনি নির্জন কালীবাড়ীতে বট বৃক্ষের নীচে বসে বিপ্লবীদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান, লাঠিখেলা, ছোড়াখেলা ও কুস্তিখেলার আয়োজন করতেন। বিপ্লবীরা মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে দেশমাতৃকার সদস্য হওয়ার জন্য জীবন বিসর্জন দেওয়ার দীক্ষা নিতেন।

তিনি নাটোরের মহারাজা রামকৃষ্ণ রায়ের জ্যেষ্ঠ ভাই ছিলেন। মহারাজা রামকৃষ্ণ দত্তক পুত্র হয়েও জমিদারির বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে যান। আর আপন পুত্র হয়েও দ্বিজরামকে তাঁর কৃপা ও ভিখারি হয়ে থাকতে হয়েছে। ঐ কারণেই তাঁর মনে সংসার ত্যাগ ও সমাজ বৈরাগ্যের জন্ম নেয়। এরপর তিনি দেবী অনুগ্রহ লাভ ও তাঁর আদেশপ্রাপ্ত হয়ে চিনিশপুরের জঙ্গল কীর্ণ পরিবেশে এসে আশ্রয় লাভ করেন। এখানকার বটবৃক্ষের নিচে দ্বিজরাম প্রসাদ পঞ্চমুণ্ডী আসন প্রস্তুত করে সেখানে বসেই ভগবানের কৃপা লাভের সাধন- ভজন শুরু করেন।

একপর্যায়ে বৈশাখ মাসের মঙ্গলবার অমাবস্যা তিথিতে তিনি সিদ্ধি লাভ করেন। সাধক দ্বিজরামের সিদ্ধিলাভের পর থেকে ঐ বটবৃক্ষটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে একটি তীর্থকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত-দর্শনার্থী বটবৃক্ষের নিচে সাধু দর্শনে ভিড় করতে থাকেন। ফলে দ্বিজরাম ৩০০ বছর আগে তাঁর ইষ্ট দেবতার নামে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে স্থাপন করেন দক্ষিণা কালীর মূর্তি। তখন থেকেই চিনিশপুর কালীবাড়ি হিসেবে সারা ভারতবর্ষে পরিচিতি পায়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা গেছে, কালীবাড়ির বয়স ২৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সে হিসাবে বটবৃক্ষের বয়স ৩০০ বছরের কম হবে না।