কালী কথা-পর্ব ১: ভয়ঙ্করীর জিভ থেকে রক্ত ঝরছে অবিরত, সেও যে ঘরের মেয়ে

শ্রীকালীচরণ ভট্টাচার্য: ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ শ্মশান। দূরে দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতা। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। চিতা থেকে কিছুটা দূরের ঘন জঙ্গলে রয়েছে এক…

Special Report on Hindu Goddess Ma Kali by Shri Kalicharan Bhattacharya

শ্রীকালীচরণ ভট্টাচার্য: ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ শ্মশান। দূরে দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতা। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। চিতা থেকে কিছুটা দূরের ঘন জঙ্গলে রয়েছে এক প্রাচীন মন্দির। সেখানে এক ভয়ঙ্করী দেবীর অবস্থান। চার হাত সম্পন্না উলঙ্গিনী দেবীকে দেখলে ভয়, রোমাঞ্চ, ভক্তি সবই আসে এক নিমেষে। দেবীর বাম দিকের ওপর এবং নিচের হাতে রয়েছে রক্তমাখা খাঁড়া, মুণ্ডমালা। ডানদিকের ওপর এবং নিচের হাতে রয়েছে অভয় এবং বরমুদ্রা। নীচে দণ্ডায়মান শিব। সদ্য কাটা মুণ্ড থেকে ঝরে পড়া রক্তপান করছে শিয়ালের দল। মাঝেমধ্যে তাদের গর্জনে শ্মশানভূমি কেঁপে উঠছে। এমন এক ভয়ঙ্করী দেবীই বাংলার ঘরের মেয়ে, আরাধ্যা দেবী।

এই দেবীই দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। রামপ্রসাদের কন্যা, রামকৃষ্ণের মা ভবতারিণী, সাধক কমলাকান্তের সাধনার ধন। তবে এই মূর্তির পিছনে রয়েছে গুঢ় রহস্য। প্রতিটিই অর্থবহ। এক অর্থে এই দেবীর যে মূর্তি আমরা দেখি, পুজো করি সেটি দেবী কালিকার বাহ্যিক রূপমাত্র।

https://video.incrementxserv.com/vast?vzId=IXV533296VEH1EC0&cb=100&pageurl=https://kolkata24x7.in&width=300&height=400

মা কালী উলঙ্গ কেন প্রথমেই জানা দরকার। তিনি শক্তি,প্রকৃতি। শক্তিকে ঢাকবে কোন বস্ত্র ? পঞ্চভূত জুড়ে যিনি বিরাজমানা, তাঁকে ঢাকার সাধ্য নেই কোনও বস্ত্রের। সেইজন্য দেবী কালী উলঙ্গিনী।

দেবীর বাম হাতে খড়গটি আসলে জ্ঞান খড়গ, যেটি দিয়ে তিনি জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে তোলেন। বামহাতের মুণ্ডমালাটি মোক্ষের প্রতীক, চৈতন্যের প্রতীক। এবার আসি ডানহাতে। মা কালীর ডান হাতের ওপরে হাতে অভয় এবং নিচের হাতে বরমুদ্রা। অর্থাৎ একদিকে তিনি নিষ্কাম ভক্ত বা সাধকদের অভয়দাত্রী অপরদিকে সংসারী মানুষকে বরদাত্রী। গলায় মুণ্ডমালা। দেখলে মনে হবে রক্তলোলুপ এই দেবী যেন রক্তপান করতে উৎসুক। আসলে সবই মায়া। দেবী কালিকার গলায় মুণ্ডমালায় থাকে ৫০টি মুণ্ড। প্রত্যেকটি মুণ্ড প্রতিটি বর্ণমালার প্রতীক। অর্থাৎ দেবীকে জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কোমরে হাতের মেখলা। এই হাতের মেখলা কর্মফলের প্রতীক। এলোকেশী দেবীর রূপ অতি ভয়ঙ্কর।

দেবীর পদতলে থাকা শিব কিন্তু দেবতা শিব নয়। আসলে তা শবরূপ শিব। শক্তি ছাড়া শিব অচল, শবের ন্যায়। শব-শিবের হৃদয়ে মা কালীর চরণ। তারমানে হল, মন যখন শবে পরিণত হয়, বাহ্যিক চেতনা যখন লোপ পায়, তখনই হৃদয়ে আবির্ভুত হন দেবী কালী। আমাদের অভ্যন্তরীণ তেজ, শক্তিই মা কালী।

তাঁর কৃপা, সদর্শন সহজ, আবার কঠিনও। মনকে করে তুলতে হবে বাহ্যিক, জড় চেতনা বিহীন। জিভ দিয়ে মা কালীর ঝরে পড়ছে রক্ত। অথচ সাদা ঝকঝকে দাঁত। লাল টকটকে জিভ রজ গুণ, খ্যাতি, নাম জশ, অহংবোধ ইত্যাদির প্রতীক। আর ঝকঝকে সাদা দাঁত সত্ত্ব গুণ অর্থাৎ নম্রতা, বিনয় ইত্যাদির প্রতীক। অর্থাৎ সত্ত্ব গুণকে শক্তিশালী করে রজগুণকে সংযত করেছেন তিনি।

শ্মশানবাসী অর্থে কিন্তু মনকে বোঝানো হয়েছে। আর এলোকেশী অর্থে তমোগুণ। ফলে, বোঝা গেল, কালী রূপের গুঢ় তত্ত্ব। আগামী পর্বে আলোচনা হবে কীভাবে প্রচলন হল বাংলায় কালীপুজো।

রক্তলোলুপ ভয়ঙ্করী দেবী কীভাবে বাংলার ঘরে মেয়ে হয়ে উঠলেন তার বিস্তারিত আলোচনা হবে পরবর্তী পর্বে।