কালী কথা পর্ব ২: ঘুঁটেওয়ালি থেকেই সৃষ্ট দেবীর রূপ, তিনিই বাগদি কন্যা কালী

শ্রী কালীচরণ ভট্টাচার্য: শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তি আন্দোলনের জোয়ার তখন সারা বাংলা জুড়ে। অন্যদিকে তন্ত্রাচারের নামে গভীর জঙ্গলে অন্ধকারে চলছে বামাচার, ব্যাভিচার। মহিলাদের নিয়ে, মদ্যপ অবস্থায়…

শ্রী কালীচরণ ভট্টাচার্য: শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তি আন্দোলনের জোয়ার তখন সারা বাংলা জুড়ে। অন্যদিকে তন্ত্রাচারের নামে গভীর জঙ্গলে অন্ধকারে চলছে বামাচার, ব্যাভিচার। মহিলাদের নিয়ে, মদ্যপ অবস্থায় সাধনার নামে অনাচারে তন্ত্রাচার তখন কার্যত নিষিদ্ধ এক প্রথা। সেই সময় নবদ্বীপে জন্ম নিলেন কৃষ্ণানন্দ ভট্টাচার্য।

কথিত আছে, কৃষ্ণানন্দ ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের সমসাময়িক। যাই হোক, কৃ্ষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন শাক্ত সাধক। কালীর উপাসক ছিলেন তিনি। তবে সেই সময় কালীর মূর্তি প্রচলন হয়নি। শিলা, যন্ত্র, ঘটে কালী পুজো হত। তখনও মা কালীর এত ঘরে ঘরে পুজো অর্চনা হত না। শ্মশান, ঘন জঙ্গলে মা কালীকে এক ভয়ংকরী দেবী হিসেবে পুজো করতেন কাপালিক, তান্ত্রিক সাধকরা, সঙ্গে চলত ব্যাভিচার।

এসবের পরিবর্তন ঘটিয়ে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটালেন আগমবাগীশ। তাঁর দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল নিজের আরাধ্যা দেবীর মূর্তিতে পুজো করার। কিন্তু কেমন হবে তাঁর মূর্তি, তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলেন না। একদিন গভীর রাতে স্বপ্নাদেশ পান, সকালে উঠে প্রথম দেখা মহিলার ভঙ্গিই হবে মা কালীর মূ্র্তি। সেইমতো খুব সকালে উঠে গঙ্গাস্নান করতে যাচ্ছিলেন তিনি। রাস্তায় দেখলেন এক গোয়ালিনী দুই হাতে গোবর দিয়ে ঘুঁটে দিচ্ছে। পরণে তাঁর শাড়ি, আলুলায়িত চুল, ঘামে ভিজে কপালের টিপ থেবড়ে গিয়েছে। আগামবাগীশকে দেখে লজ্জায় জিভ কাটলেন ওই মহিলা। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ে গেল স্বপ্নাদেশ। সেই মতো তৈরি করলেন দক্ষিণাকালীর মূর্তি।

”খড়গহস্তা, রক্তস্নাত এই ভয়ংকরী দেবীই এক সারিতে বসিয়েছেন ডাকাত এবং গৃহস্থকে, কাপালিক এবং গৃহী ব্যক্তিকে ”

এরপর আগমবাগীশ পুজোর আচার, পদ্ধতি সমস্ত কিছু সহজ সরল করে বর্ণনা করলেন তাঁর গ্রন্থ বৃহৎ তন্ত্রসারে। এই দক্ষিণাকালীই কালক্রমে হয়ে উঠলেন বাংলার ঘরের মেয়ে, মা। ডাকাত, গৃহস্থ উভয়ের আরাধ্যা মা কালী। নবদ্বীপে আজও তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেবী দক্ষিণাকালী আগমেশ্বরী পুজো পান।

কালক্রমে ব্যাভিচার, অনাচারের পথ ছেড়ে আগমবাগীশের হাত ধরে তন্ত্রাচারে এসেছে বিপ্লব। ঘরে ঘরে দেবী কালীকার পুজো হয় বঙ্গে। কোথাও তন্ত্রমতে, কোথাও বৈষ্ণবমতে কালী আরাধিতা। তিনিই একমাত্র দেবী যাঁকে গভীর রাতে পুজো দিয়ে ডাকাতি করতে যেত ডাকাতরা, আবার মন্দিরে মাকে প্রণাম করে ঘুমাতে যান গৃহস্থ। উলঙ্গিনী, খড়গহস্তা, রক্তস্নাত এই ভয়ংকরী দেবীই এক সারিতে বসিয়েছেন ডাকাত এবং গৃহস্থকে, কাপালিক এবং গৃহী ব্যক্তিকে। বৈষ্ণব আর শাক্তকে তিনিই তো মিলিয়েছেন রটন্তীকালী রূপে।

কথিত আছে আয়ান ঘোষের স্ত্রী রাধিকা রোজ রাতে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। জটিলা ও কুটিলার পরামর্শে আয়ান ঘোষ স্ত্রীকে অনুসরণ করেন। সেখানে গিয়ে দেখেন মা কালীকে পুজো দিচ্ছেন রাধিকা। রটনা খণ্ডাতে, শ্রীকৃষ্ণ রাধিকাকে কলঙ্কমুক্ত করেছিলেন কালীরূপ ধারণ করে। তাই দেবীর এই রূপ রটন্তী কালী বলে পরিচিত। দেবী কালিকা আবার বাগদির মেয়ে হিসেবে পরিচিত হয়ে জাতপাতের ভেদ ঘুঁচিয়েছেন।

পরের পর্বে কালী কথায় থাকবে দেবীকে আরও কিছু আরও কিছু কৌতুহল