পুরাণ কথা: জগন্নাথ ও রথযাত্রার ইতিহাস-অন্তিম পর্ব

সোমবার, ২৭ আষাঢ় অর্থাৎ ইংরাজির ১২ জুলাই শুভ রথযাত্রা৷ প্রথম পর্বে জগন্নাথ মূর্তি ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আমরা জেনেছি৷ দ্বিতীয় পর্বে আমরা জানবো রথযাত্রা কী…

সোমবার, ২৭ আষাঢ় অর্থাৎ ইংরাজির ১২ জুলাই শুভ রথযাত্রা৷ প্রথম পর্বে জগন্নাথ মূর্তি ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আমরা জেনেছি৷ দ্বিতীয় পর্বে আমরা জানবো রথযাত্রা কী এবং কেন হয়? যা নিয়ে লিখলেন টিঙ্কু মণ্ডল

মাহেশের রথযাত্রা: ১৩৯৬ খ্রীষ্ঠাব্দ থেকে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে মাহেশের রথ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে৷ এবার ৬২৫ বছরে পর্দাপণ করল এই রথযাত্রা৷ প্রথা অনুযায়ী স্নান পিঁড়িতে জগন্নাথের সঙ্গে স্নান করেন বলরাম ও সুভদ্রা৷ এখনও স্নান যাত্রার দিনে ২৮ ঘড়া গঙ্গাজল ও ২ মন দুধ দিয়ে স্নান করানো হয় এই বিগ্রহকে৷ তারপর তিনটি বিগ্রহকে কম্বলে মুড়িয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে রাখা হয়৷ এরপর রথের আগের দিন জগন্নাথকে রাজবেশ পড়ানো হয় এবং তাঁর এই রূপকে নবযৌবন বলা হয়৷ তারপর তিন বিগ্রহকে রথের দিন মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়৷ মাহেশের এই রথটি পুরীর মতো কাঠের তৈরি নয়৷ এটি সম্পূর্ণ লোহার তৈরি, যা ১৩৬ বছরের পুরনো৷ এর উচ্চতা ৫০ ফুট৷ এই রথের সামনে রয়েছে দু’টি তামার ঘোড়া৷ একটি রথে তিন বিগ্রহকে নিয়ে পরিভ্রমণ করা হয়৷
চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন৷ তাঁর মনে সাধ জেগেছিল, জগন্নাথ দেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়ানোর৷ কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা বাধা দেওয়ায়, তিনি তা করতে পারেননি৷ মনের দু:খে তিনি তখন আমরণ অনশনে বসেন৷ এর ঠিক তিন দিন পর জগন্নাথ দেব স্বয়ং তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বলেন, তিনি যেন বঙ্গদেশে ফিরে যান এবং ভাগীরথীর তীরে মাহেশ নামক যে গ্রাম রয়েছে, সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন৷ তিনি আরও বলেন, সঠিক সময়ে সেই নদীতে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম কাঠ ভেসে আসবে৷ সেই কাঠ দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি গড়ে পুজো করতে হবে৷ তারপরই ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর হাতে ভোগ খাবেন শ্রী জগন্নাথ৷ এই স্বপ্নাদেশের পরই ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী মাহেশে এসে ভগবানের আরাধনা শুরু করেন৷ তারপর এক বর্ষার দিন মাহেশের ঘাটে একটি নিম কাঠ ভেসে আসে৷ তিনি সেই কাঠ দিয়ে মূর্তি তৈরি করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের হাতে জগন্নাথ দেবকে ভোগ নিবেদন করেন৷

১৭৫৫ সালে কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশের মন্দির নির্মাণ করেন৷ যা আজও বর্তমান৷ সেই সময় ২০ হাজার টাকা দিয়ে শ্যামবাজারের বসু পরিবারের সদস্য কৃষ্ণচন্দ্র বসু এই লোহার রথটি নির্মাণ করেন যা ‘নবরত্ন’ নামে পরিচিতি৷ মাহেশের এই রথ ‘নীলাচল’ নামেও প্রসিদ্ধ৷ কথিত আছে, জগন্নাথ দেবের ভক্ত শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু একবার এই রথ যাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন এবং এখানে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েন ও গভীর সমাধিতে চলে যান৷ তারপর থেকে মাহেশের এই রথ ‘নব নীলাচল’ নামে পরিচিতি লাভ করে৷ এই ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এবং তাঁর স্ত্রী মা সারদাদেবী৷ এমনকী সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নাট্যকার গিরীশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ মানুষেরা এই রথের বিখ্যাত মেলা দেখতে এসেছিলেন৷ রথযাত্রায় এখানে ভোগ হিসেবে পোলাও, খিচুড়ি, আলুরদম, ধোঁকার ডালনা, পনীর, পায়েস ইত্যাদি নিবেদন করা হয়৷

মায়াপুরের ইসকন রথযাত্রা: পুরী ও মাহেশের মতো মায়াপুরে ইসকনের রথযাত্রাও বিখ্যাত৷ গ্রামের প্রশান্তপল্লীতে আয়োজিত এই রথযাত্রা উৎসবে সামিল হন সকল গ্রামবাসীরা৷ এমনকী বাইরে থেকে আসা অনেক তীর্থযাত্রীও এই রথযাত্রার আনন্দ উপভোগ করেন৷ রথযাত্রার দিন পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে রথ পৌঁছয় মায়াপুর ইসকনের চন্দ্রদয় মন্দিরে৷ যা ঐ অঞ্চলে জগন্নাথের মাসির বাড়ি নামে খ্যাত৷ সাতদিন পর অর্থাৎ উলটো রথে জগন্নাথ দেব ফিরে যান ইসকনের মূল মন্দিরে৷ এই সাত দিন এখানে ৫৬ ভোগ, দীপ দান, জগন্নাথ অষ্ঠকম পাঠ ইত্যাদি চলতে থাকে৷ এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রসাদ বিতরণ করা হয়৷ প্রভুপাদ ঘাটে বসে রথের মেলা৷ শোনা যায়, প্রশান্তপল্লী-রাজাপুর জগন্নাথ দেবের কৃপায় বর্তমানে রথযাত্রা উপলক্ষ্যে এক আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে৷ জয় জগন্নাথ ধ্বনিতে ওই দিন সমগ্র আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে৷ জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার জন্য তিনটি আলাদা আলাদা রথের ব্যবস্থা থাকে৷ এছাড়াও এই শোভাযাত্রায় ঘোড়া ও পালকির ব্যবস্থাও থাকে৷

মহিষাদলের রথযাত্রা: ষষ্ঠদশ শতকে মুঘল সেনাবাহিনী প্রধান উচ্চপদস্থ কর্মচারী জনার্দন উপাধ্যায় ব্যবসার কাজে নদী পথে এসেছিলেন মহিষাদলের সন্নিকটে গেঁওখালিতে৷ বাংলার প্রাকৃতিক শোভায় মুগ্ধ হয়ে মহিষাদলে তৎকালীন রাজা কল্যাণ রায়চৌধুরীর কাজ থেকে নিলামী জমিদারী কিনে নেন৷ এখান থেকেই সুত্রপাত ঘঠে মহিষাদলের রাজপরিবারের৷ জনার্দন উপাধ্যায়ের পুত্র ছিলেন রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায় ও রানি জানকি উপাধ্যায়৷ তাঁদের কোনও পুত্র সন্তান না-থাকায় আনন্দলালের মৃত্যুর পর জানকি দেবী রাজত্বের দায়িত্ব নেন৷ তিনি একদিন স্বপ্নাদেশ পান যে, নদীর জলে শালগ্রাম শীলা ভেসে আসছে এবং এই শীলাকে রাজবাড়ীর কুলদেবতা হিসেবে বরণ করতে হবে৷ তারপর ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজবাড়ির সামনে একশো ফুট উঁচু মন্দির তৈরি করে কুলদেবতাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ একদিন রানি জানকি দেবীর কাছে প্রজারা আবেদন জানায়, পুরীর মতো এখানও রথযাত্রা উৎসব পালন করতে হবে৷ তারপর ১৭৭৬ সালে মহিষাদলের রথযাত্রা শুরু করেন জানকি দেবী৷ প্রথমে এই রথে ২০টি চাকা ছিল৷ তারপর ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জামাতার পুত্র গুরপ্রসাদ গর্গ রথের সংস্করণ করিয়ে ১৭টি থেকে কমিয়ে ১৩টি চূড়া এবং ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩৪টি চাকা নির্মাণ করেন৷ পাঁচতলা বিশিষ্ট এই রথের প্রত্যেক তলাতে রয়েছে বারান্দা এবং চার কোণে বসানো রয়েছে চার ঋষির মূর্তি৷ অনান্য রথের মতো এই রথে জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ থাকে না৷ থাকে রাজপরিবারের কুলদেবতা গোপাল জিউ ও রাজরাজেশ্বরী শিলা৷ রথযাত্রার আগের দিন এখানে ‘নেত্র উৎসব’ পালিত হয়৷ এই উৎসবে রাজপরিবারের সদস্য রথের চারটি রশি বেঁধে রথযাত্রার উদ্বোধন করেন৷ এক সময় রাজবাড়ীর নিজস্ব হাতি ছিল, যার পিঠে বসেই মাহুত লাল নিশান দেখাতেন এবং তারপর রাজবাড়ি থেকে পালকি চড়ে আসতেন রাজবাড়ির সদস্যরা৷ তারপর কামান দেগে শুরু হত রথযাত্রার৷ আজও এই প্রথা মেনে রথ উৎসব পালন করেন রাজপরিবারের সদস্য৷