Kolkata Durga Puja: হাতিবাগানের অলি গলিতে হন্যে হয়ে হাতি খুঁজলে আপনি হতাশ হবেন ঠিকই। কিন্তু ঠিকঠাক মতো খুঁজলে খাস হাতিবাগানের বুকেই আপনি বাঘের দেখা পেতে পারেন। একটা আস্ত বাড়ির খোঁজ যার কোনায় কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে বাঘেরা। আর আশ্বিনের শারদপ্রাতে যদি আপনি পৌঁছে যান সেই বাড়িতে, তাহলে খোঁজ পেয়ে যাবেন এমন এক দেবীর যিনি কিনা ‘ব্যাঘ্রবাহিনী’।
হঠাৎ মনে হতেই পারে যে শরৎকালীন নবরাত্রির সময় তো মা শেরাওয়ালীর পুজো তো সারা ভারতবর্ষ জুড়েই হয়। এতে আলাদা করে বলার কি আছে? কিন্তু আমাদের বাঙালিদের ঘরের মেয়ে উমা, মা দুর্গা, তিনি তো সিংহবাহিনী। সিংহের পিঠে চড়ে মহিষাসুর নিধনে মত্ত। কিন্তু হাতি বাগানের কুন্ডু বাড়ির উপমা সিংহ নয় বাঘের পিঠে চড়ে মহিষাসুর বধ করেন প্রতিবছর।
সাধারণত আমরা দেখি যে প্রাচীন বনেদি পুজোগুলোতে এই ধরনের বিশেষ কোন রীতি বা রেওয়াজ দেখা যায়। কিন্তু কুন্ডু বাড়ির পুজো বয়সে প্রবীণ নয় বরং বেশ নবীনই বলা যায়। তালে হঠাৎ করে এই পুজোর এই বিশেষ রীতি কেন? এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে বাঘেদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং পরিবেশ চেতনার বোধ।
এই পুজোর মূল আয়োজক জয়দীপ কুণ্ডু এবং তার স্ত্রী সুচন্দ্রা কুন্ডু। জয়দীপবাবুর নেশা, পেশা বা প্যাশন যাই বলুন না কেন, সেটা হল বাঘ। ব্যাঘ্র বিশারদ জয়দীপবাবুর বাড়ি জুড়ে আনাচে-কানাচে তাই বাঘের বিভিন্ন ছোট বড় মূর্তি থেকে শুরু করে ছবি বা মুৱ্যালের ছড়াছড়ি। স্ত্রী সুচন্দ্রারও পছন্দের বিষয় হয়ে গিয়েছে বাঘ সংরক্ষণ। বাঘ সংরক্ষণ কর্মসূচির অন্যতম উদ্যোক্তা কুন্ডু দম্পতির জীবনে বাঘ একটা অন্যতম অবিচ্ছেদ্য চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজ থেকে ১৬ বছর আগে নিজেদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজন শুরু করেছিলেন জয়দীপবাবুরা। আর সে সময় থেকে নিজেদের প্রিয় পছন্দের বাঘকেই দেবীর বাহন হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করেন তাঁরা। আর তারই ফলশ্রুতিতে হাতিবাগানের বুকে শুরু হয় দেবী ব্যাঘ্রবাহিনীর আরাধনা।
শুধু বাঘ নয়, এই পূজাতে আরও কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। কুন্ডুবাড়ির ঠাকুরঘরেই প্রতিমা তৈরি করেন সুদূর বহরমপুর থেকে আসা কারিগরেরা। প্রতিমার রং করেন কুন্ডু বাড়ির সদস্য থেকে শুরু করে তাদের বন্ধু পরিজনেরা নিজেদের হাতে। প্রতিমার রঙের ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ সীসা বিহীন এবং পরিবেশ বান্ধব রঙের ব্যবহার প্রথমদিন থেকেই করা হচ্ছে। যাতে পরিবেশের ক্ষতিকারক কার্বন ফুটপ্রিন্ট একেবারে ন্যূনতম হয়।
প্রতিমার সাজসজ্জাতেও বিশেষত্ব রয়েছে। পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক শোলার সাজ, এমনকি আঠার ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব আঠা। আর এই সাজ তৈরি হয় সুদূর বর্ধমানের বনকাপাসিতে। বনকাপাসীর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শোলা শিল্পী আশীষ মালাকার নিজের হাতে তৈরি করেন এই সাজ। প্রতিমার চালচিত্রতেও রয়েছে অভিনবত্ব। প্রতিবছরই চালচিত্রে কোনও না কোনও পশুর মোটিফ ব্যবহার করা হয়। কোনো বছর হাতি তো কোনো বছর ঘোড়া।
এমনকি পূজোর দিনগুলোতে, বাড়ির ডেকোরেশন থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুতে প্লাস্টিকের ব্যবহার যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। পুজোর ভোগ বিতরণ করা হয় বায়ো-ডিগ্রেডেবল আখের ছিবড়ে দিয়ে তৈরি থালা বাটিতে। কুন্ডু দম্পতি শুধু মুখেই পরিবেশ সচেতনতা, ব্যাঘ্র সংরক্ষণ বা পরিবেশ আন্দোলনের কথা বলেন না। তাঁরা তাদের নিজেদের জীবন-যাপন এবং নিজেদের বাড়িতে পুজোর ক্ষেত্রেও অক্ষরে অক্ষরে সেটা হাতে-কলমে করে দেখাবার চেষ্টা করেন।
পেশায় ব্যাঘ্র বিশারদ হলেও জয়দীপবাবুর কিন্তু আরও একটা পরিচয় আছে। তিনি সুদক্ষ অভিনেতাও। একাধিক নামকরা সিনেমা এবং সিরিয়ালে তাঁর দাপুটে অভিনয় দেখতে পাওয়া যায়। ফলে উৎসবের দিনগুলিতে কুন্ডুবাড়িতে তারকার হাট বসে। টলিউডের নামিদামি তারকারাও দেবী ব্যাঘ্রবাহিনী দর্শনে আসতে ভোলেন না। বোধন থেকে বিসর্জন, বাড়ির পুজো হলেও আনন্দ আর উদযাপনে যেকোনো বারোয়ারিকে মাত দিতে পারে কুন্ডু বাড়ির এই ব্যাঘ্রবাহিনীর পুজো।
তাই এই বছর উত্তর কলকাতার নামি-দামি বারোয়ারি পুজোর প্যান্ডেল হপিংয়ের মধ্যেই চলে আসতে পারেন কুন্ডু বাড়িতে। বিখ্যাত স্টার থিয়েটারের কাছাকাছি অবস্থিত এই বাড়ির ঠিকানা যে কাউকে বললেই পেয়ে যাবেন। দেবী ব্যাঘ্রবাহিনী আর কুন্ডু দম্পতির আতিথেয়তা আপনাকে যে মুগ্ধ করবেই করবে, সেটা হলফ করে বলাই যায়।