বিরোধী ইন্ডিয়া (I-N-D-I-A) জোটের মুম্বই সামিটে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে দলীয় আসন সমঝোতা নিয়ে তদ্বির করছেন তৃণমূল নেত্রী তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক সেই সময় ধূপগুড়ির মঞ্চে একসঙ্গে বসে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে একেরপর এক তির ছুঁড়েছেন কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী (Adhir Ranjan Chowdhury) সঙ্গে সিপিএমের মহম্মদ সেলিম।
এর পরেই ধূপগুড়ি উপ নির্বাচনে বাজিমাত করে তৃণমূল। বিজেপি প্রার্থী তাপসী রায়কে ৪,০০০-র বেশি ভোটে হারিয়ে বিজয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী নির্মলচন্দ্র রায়। একেবারে ধসে ভেঙে বাম-কংগ্রেস জোট। ধূপগুড়ি নির্বাচনের সূত্রে সারাংশ বদলে ফেলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাসফুল শিবির।
সূত্র মারফৎ জানা গিয়েছে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় স্তরের মূল বিরোধী দল কংগ্রেসের সঙ্গে সামান্য সৌজন্য মূলক ভাবে মালদা এবং মুর্শিদাবাদের দুটি আসন ছেড়ে দিতে চাইলেও, সিপিএমের সঙ্গে কোনও আসন সমঝোতা করতে নারাজ তৃণমূল। তাঁদের দাবি, ধূপগুড়িতে জেতার পরেই দলের শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মঙ্গলবার নয়াদিল্লির দলীয় সূত্রে দাবি, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় কংগ্রেসকে মাত্র দুটি আসন ছাড়তে রাজি হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস। দাবি তৃণমূল সূত্রের দাবি, এই মুহূর্তে মুর্শিদাবাদ এবং মালদা ছাড়া কোনও লোকসভা আসনেই কংগ্রেসের জেতার সুযোগ নেই। এরই সঙ্গে, আগামী লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএম বা বামদলগুলির সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতা নয়। তাদের সোজা কথা, কেরলে যেমন কংগ্রেস এবং সিপিএমের মধ্যে জোট হওয়া সম্ভব না তেমনি পশ্চিমবঙ্গেও সিপিএমের সঙ্গে জোট বাধতে নারাজ তৃণমূল। তৃণমূল কংগ্রেসের এইরূপ আভ্যন্তরীণ স্ট্যাটেজি প্রকাশ্যে আসায় রাজনৈতিক জল্পনা চরমে উঠেছে৷
কিন্তু হঠাৎ এই অবস্থান কেন? এ প্রশ্নের জবাবে বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ মনে করছেন, ইন্ডিয়া জোটের মুম্বই মিটিংয়ে আসন ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতিশ কুমার, লালু প্রসাদ যাদব সহ একাধিক শীর্ষনেতৃত্ব এই আসন ভাগাভাগি বিষয়ে অতি দ্রুত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন। এখানে প্রাথমিকভাবে ঠিক হয় যে যে রাজ্যে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ বা শক্তিশালী তারাই আসন সমঝোতার ব্যাপারে শেষ সিদ্ধান্ত নেবে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসই এই বিষয়ে শেষ কথা বলবে, তা সহজেই অনুমেয়। আর সেই মর্মেই তৃণমূল কংগ্রেসের এহেন সিদ্ধান্ত, যা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে।
এই টানটান আবহে বুধবার বিকেলে এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পওয়ারের দিল্লির বাসভবনে টিম ইন্ডিয়ার আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনায় বসার কথা মুম্বই সামিটে নির্মিত ইন্ডিয়া জোটের কো অর্ডিনেশন কমিটির। এই কমিটির অন্যতম সদস্য তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কাল বৈঠকে থাকছেন না বলে জানা গেছে৷ ওই একই দিনে অভিষেককে কলকাতায় ইডি দফতরে হাজিরা দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। ইডির তলব নিয়ে কটাক্ষ করে অভিষেক টুইটে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, ‘যেদিন ইন্ডিয়া জোটের কো অর্ডিনেশন কমিটির বৈঠক, সেদিনই ইডির তলব৷ ছাপ্পান ইঞ্চি সরকার কতটা ভীত, সন্ত্রস্ত তা বোঝা যাছে।’
এর পরেই প্রশ্ন উঠেছে, তবে কে অভিষেকের স্থানে কো অর্ডিনেশন কমিটির বৈঠকে অংশ নেবেন? তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই জল্পনাও নস্যাৎ করেছে তৃণমূল। দলের তরফে কেউই বুধবারের বৈঠকে অংশ নেবেন না, এরই মধ্যে সে বার্তা এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পাওয়ার এবং কংগ্রেসের কেসি বেণুগোপালের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন দলীয় মুখপাত্র এবং বর্ষীয়ান সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। এর ফলে স্পষ্ট হয়ে গেল, আসন সমঝোতা নিয়ে এই মুহূর্তে কোনও আলাপ-আলোচনায় অংশ নিতে চাইছে না ঘাস ফুল শিবির। বিষয়টি পাশ কাটিয়ে গেলেও এই দিন আসন সমঝোতা নিয়ে রাজ্যস্তরে ‘অনড়’ মনোভাব স্পষ্ট করেছে তৃণমূল শিবির।
বুধবার এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে মনে করছে জোট শরিকরা। কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অভিষেক বা তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি কেন্দ্রীয়স্তরে তৃণমূল কংগ্রেসের মনোভাব ব্যক্ত করেছে। তৃণমূলকে বাদ দিয়েই আগামীকাল কী পদক্ষেপ নেয় জোট ইন্ডিয়া শিবিরের কো অর্ডিনেশন কমিটি, নজর রাখা হচ্ছে সেদিকেই। জোটের পরবর্তী বৈঠক হতে পারে ভোপালে, তবে এখনও তার দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি, বুধবারের বৈঠকে তা চূড়ান্ত হবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
এদিকে আগামীকাল ইডির তলব অভিষেক ব্যানার্জিকে, এই মামলায় হস্তক্ষেপ করলো না আদালত। তবে আদালতে একটু হলেও স্বস্তি পেয়েছেন অভিষেক। অভিষেককে সমন করা হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন কড়া পদক্ষেপ নয়, আদালতে আশ্বাস দিল ইডি। কিছু তথ্যের জন্যই সমন, মন্তব্য ইডির আইনজীবীর। বিচারাধীন মামলায় কোনও দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ। যদিও আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি জানিয়েছেন, ইডি অভিসন্ধি করেই এই সমন পাঠিয়েছে। আর কোন তথ্যই দেওয়ার নেই। তাও সমন পাঠানো হচ্ছে।
অন্যদিকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কো অর্ডিনেশন কমিটির বৈঠকে না থাকা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যস্তরীয় আসন সমঝোতা ভিত্তিক অবস্থান নিয়ে এদিন তীব্র কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহ. সেলিম। তিনি বলেন, ‘এটা তো জানা বিষয়৷ তৃণমূল কোনও আসন সমঝোতা করবে না আমরা জানতাম৷ তাতে কিছু যায় আসেনা। বামেরা রাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপি – দুই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধেই লড়বে।’ কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ, বর্ষীয়ান সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ‘যা ইচ্ছে তা-ই করুক তৃণমূল। এই নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। শীর্ষ নেতৃত্ব যে আদেশ দেবে, তা মেনেই কাজ করবে প্রদেশ কংগ্রেস।’