সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় : ১৯১১ সাল বললেই বাঙালির মনে পড়ে যায় মোহনাবাগানের ব্রিটিশদের হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জেতার কথা৷ বাঙালিদের কাছে তো বটেই গোটা দেশের কাছে সেদিনের মোহনবাগানের জয়টা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে গিয়েছে ৷ সেই জয়ের মাধ্যমে যেন পরাধীনতার গ্লানি থেকে আলাদা মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল কলকাতার মানুষ৷ তবে মোহনবাগানের শিল্ড জেতা ছাড়াও ১৯১১ সালে আরও দু’টি ঘটনা ঘটেছিল বঙ্গজীবনে৷ একটা হল স্বদেশি আন্দোলনের জেরে ব্রিটিশ সরকার পিছু হটে বঙ্গভঙ্গ রদ করেছিল৷ অন্যদিকে ঘোষণা করা হয়, ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হবে৷ এক প্রকার বলা চলে কলকাতার শনির দশার শুরু সেদিন থেকে-অর্থাত ১২ ডিসেম্বর।
গত শতাব্দীর শুরুতে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব ছিল বাঙালির নিয়ন্ত্রণে৷ আর তখন বাঙালিই বলতে গেলে গোটা দেশকে পথ দেখাচ্ছে। ভারতের রাজধানী কলকাতায় বাঙালির প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী মনোভাব দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন লর্ড কার্জন৷ রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন বাঙালিকে দুর্বল করতে ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগকেই একমাত্র উপায় বলে মনে হয়েছিল বড়লাটের ৷ বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ চেয়েছিল, একটি মুসলমান প্রধান রাজ্য গঠন করতে ৷ এর আসল উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা ৷ কার্জনের পরিকল্পনা বানচাল করতে নড়ে চড়ে ওঠে বাঙালি৷
ওই সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীরা যখন লড়ছে তখনই আবার ফুটবল মাঠে গোরাদের বিরুদ্ধে লড়ে গেল মোহনবাগান৷ ১৯১১সালে ২৯জুলাই ব্রিটিশদের দল ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে মোহনবাগান ক্লাব আই এফ এ শিল্ড জিতল৷ বুট পরা গোরাদের সঙ্গে সেদিন খালি পায়ে খেলে ২-১ গোলে জিতেছিল মোহনবাগান ৷ যা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলেনর যুগে অন্যমাত্রা পেয়েছিল৷
কিন্তু এই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যেই অবশ্য ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানাস্থরিত করার কথা ঘোষণা করেছিলেন সম্রাট পঞ্চম জর্জ। আর সেদিনই অবশ্য ঘোষণা করা হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ রদের কথা। দ্বিতীয় ঘোষণার জন্য নিয়ে বাঙালির বিজয়োল্লাসের শেষ ছিল না৷ অনেকেই সেদিন গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন-Settle Fact -কে Unsettle Fact করা গিয়েছে৷ কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদের অন্তরালে এই রাজধানী স্থানান্তরের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দিক থেকে চরম আঘাত আনা হয়েছিল কলকাতার উপর। সেদিনের capital shift এর অর্থ শুধুমাত্র রাজধানী স্থানান্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা যে আদতে কলকাতা থেকে মূলধনের স্থানান্তরও ঘটিয়েছিল ৷
বক্তৃতা- গান- বোমার মাধ্যমে যারা বঙ্গভঙ্গ রদ করতে চেয়েছিলেন তাদের যেন তখন উচিত শিক্ষা দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশ সম্রাট ৷ তাঁর কূটনৈতিক চাল তখন বুঝতে পারেনি আপামর বাঙালি৷ তখন থেকেই আসলে শুরু হল কলকাতার পতন ৷ আর তার আগে দুই শতাব্দী ধরে নানা আক্রমণে জর্জরিত দিল্লি যেন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ পেল৷ কলকাতার এসপ্লানেড- ডালহাউসি অঞ্চল থেকে সরকারি দফতর সরল দিল্লিতে৷ আবার ক্লাইভ স্ট্রিট অথবা চৌরঙ্গিতে থাকা ম্যানেজিং এজেন্সিগুলি কেমন যেন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে লাগল প্রতিদ্বন্দ্বী বম্বের সঙ্গে ৷ ফলে সেদিন থেকে দিল্লির পৌষ মাস আর কলকাতার সর্বনাশের শুরু ৷
বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও তার আগে অনেক রক্ত ক্ষয়,জেল দ্বীপান্তর ঘটেছিল ৷ অন্যদিকে অর্থনৈতিক ক্ষতির সীমা পরিসীমা থাকল না৷ রাজনৈতিক প্রতিবাদের ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গ আবার একত্রিত হল ঠিকই কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিক এক নতুন বিভক্তির মাধ্যমে বিহার, ওডিশা, অসমের অঞ্চলগুলো বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা হয়।
পাট ও অন্যান্য কৃষি পণ্যে সম্বৃদ্ধ সুর্মা ভ্যালি বেরিয়ে গেল৷ বাদ পড়ল খনিজ সম্পদে সম্বৃদ্ধ মানভূম সিংভূম জেলা৷ একদিকে পাটের মতো কৃষি পণ্য অন্যদিকে লোহা কয়লা ম্যাঙ্গানিজ অভ্র সহ কত রকমের খনিজ পণ্য সম্বৃদ্ধ অঞ্চলকে বাংলা হারাল৷ বাংলার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়ে বাঙালির উপর ভালই প্রতিশোধ নিল ব্রিটিশ৷ পাশাপাশি রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি এমনই অস্থির করে তোলা হল যার জেরে সাড়ে তিন-চার দশক পরে সেই বঙ্গভঙ্গকেই মেনে নিল বাঙালি৷ ভারত স্বাধীন হলেও বঙ্গের মানুষকে দেশভাগের যন্ত্রণা সইতে হল৷ধাক্কা খেল পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-অর্থনীতি৷ উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আরও পিছিয়ে পড়তে লাগল কলকাতা ৷ অন্যদিকে স্বাধীন ভারতের রাজধানী হয়ে দিল্লি তর তর করে এগিয়ে চলল ৷
