অপারেশন ব্লু স্টার: ভারতীয় রাজনীতির কালো অধ্যায়ে ঠিক কী ঘটেছিল?

অপারেশন ব্লু স্টার…ভারতীয় রাজনীতির আরো এক কালো অধ্যায় যা গোটা দেশকে শিহরিত করেছিল। আজ এই ঘটনার ৩৮ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু আপনি কি জানেন যে…

অপারেশন ব্লু স্টার…ভারতীয় রাজনীতির আরো এক কালো অধ্যায় যা গোটা দেশকে শিহরিত করেছিল। আজ এই ঘটনার ৩৮ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু আপনি কি জানেন যে অপারেশন ব্লু স্টারে ঠিক কী ঘটেছিল?

১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়ের পাশাপাশি, ইন্দিরা গান্ধীও পাঞ্জাব প্রদেশে একটি বিশাল পরাজয়ের মুখোমুখি হন। সেই পরাজয় কাটিয়ে উঠতে পাঞ্জাবে প্রকাশ সিং বাদলের নেতৃত্বাধীন আকালি দল সরকার ক্ষমতায় আসে, কংগ্রেস এমন এক ব্যক্তির আশ্রয় নেয়, যিনি সাত বছরের মধ্যে পাঞ্জাব ছাড়া গোটা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।


অপারেশন ব্লু স্টারের কারণে এই উত্থান ঘটে, যা ভারতীয় রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ ভারতের ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা যাকে কার্যত বলা হয় ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর স্ক্রিপ্ট, যা ইন্দিরা গান্ধী নিজেই কোথাও লিখেছেন। এ দিন জর্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অপারেশন ব্লু স্টারের সমাপ্তি ঘটে। আসুন জেনে নেওয়া যাক ভিন্দ্রানওয়ালে কে এবং কীভাবে অপারেশন ব্লু স্টার দেশের রাজনীতির গতিপথ বদলে দিয়েছিল।

১৯৭৭ সালে শিখ ধর্মীয় প্রচারের মূল শাখা ‘দামদমি তকশাল’-এর জাঠদার করা হয় জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালেকে। সেই সময় পঞ্জাবের রাজনীতিতে বড় মুখ হয়ে ওঠে ভিন্দ্রানওয়ালে। তবে ভিন্দ্রানওয়ালে সমস্যায় পড়েছিলেন। প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার তাঁর বই ‘বিয়ন্ড দ্য লাইন অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’তে লিখেছেন, সঞ্জয় গান্ধী ভিন্দ্রানওয়ালেকে টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু, বিন্দ্রানওয়ালে যে সন্ত্রাসের পথ বেছে নেবেন, তা তাঁর জানা ছিল না।


ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮০ সালের নির্বাচনে জয়ী হন। ৫২৯টি লোকসভা আসনের মধ্যে কংগ্রেস পায় ৩৫১টি আসন। গিয়ানি জৈল সিংকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন। পাঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস অকালি দলকে পরাজিত করে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী করা হয় দরবার সিংকে। পাঞ্জাবে হারের পর আকালি দল তাদের পুরনো ইস্যুতেই চলে যায়। যে বিষয়টি ১৯৭৩ সালে অনন্তপুর সাহেব রেজোলিউশন থেকে জানা যায়। যেখানে চণ্ডীগড় ও নদীগুলির জল ভাগাভাগি নিয়ে একতরফা দাবি জানানো হয়েছিল।

আকালি ও দরবার সিং সরকারের মধ্যে উত্তেজনা ছিল যে পাঞ্জাবের রাজনীতি ভাষা ও ধর্মের খপ্পরে জড়িয়ে পড়েছে। একটি আদমশুমারির সময়কাল ছিল এবং মানুষকে তাদের ধর্ম এবং ভাষা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে, সংবাদপত্র পাঞ্জাব কেশরী হিন্দির জন্য প্রচার করেছিল, যা পরিবেশকে আরও খারাপ করে তোলে। হিন্দির এই প্রচার ভিন্দ্রানওয়ালে সহ কট্টর শিখদের ক্ষুব্ধ করেছিল।

এদিকে, ১৯৮১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র ব্যক্তিরা পাঞ্জাব কেশরীর সম্পাদক লালা জগৎ নারায়ণকে গুলি করে হত্যা করে। এর জন্য দায়ী করা হয় জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালেকেও। লালা জগৎ নারায়ণের হত্যার পর ১৫ ই সেপ্টেম্বর অমৃতসরের গুরুদোয়ারা গুরুদর্শন প্রকাশ থেকে ভিন্দ্রানওয়ালেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে সে জামিন পেয়ে যায়।

এরপর পাঞ্জাবকে একটি পৃথক দেশ করার দাবি যখন জোরালো হয়ে ওঠে তখন ভিন্দ্রানওয়ালেকে নিয়ে রাজনীতি চলতে থাকে। সেইসঙ্গে হানাহানি ও রক্তপাত বেড়েই চলেছে। মুক্তির পর ভিন্দ্রানওয়ালেও তাইশ-এ ছিলেন। এদিকে, দিল্লিতে এশিয়াড গেমস ১৯৮২ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এর প্রতিবাদে জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে একটি বিক্ষোভের ঘোষণা করেন। তখন নিরাপত্তার নামে ১৫০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

এখন কট্টর শিখদের ক্ষোভ বেড়ে চলে, যার সুযোগ নেন ভিন্দ্রানওয়ালে। মধ্যপন্থীদের কণ্ঠস্বর দুর্বল হতে শুরু করে। ভিন্দ্রানওয়ালের ক্রমবর্ধমান প্রভাব অকালিদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এদিকে, পাঞ্জাবের ডিআইজি এএস আটওয়ালকে স্বর্ণমন্দিরের সিঁড়িতে হত্যা করা হয়। এএস আটওয়ালের দেহ স্বর্ণমন্দিরের সিঁড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে ছিল এবং মন্দিরের সিঁড়ি থেকে কেউ তার দেহ সরানোর সাহস পায়নি। মুখ্যমন্ত্রী দরবার সিংকে এএস আটওয়ালের দেহ সরানোর জন্য জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের কাছে অনুরোধ করতে হয়েছিল। এই ঘটনার পর ইন্দিরা গান্ধী স্বর্ণমন্দিরের ভিতরে পুলিশ পাঠানোর জন্য গিয়ানি জাইল সিং-এর কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে ভিন্দ্রানওয়ালের মনোবল বেড়ে যায়। পাঞ্জাবের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে ওঠে হয়ে উঠছিল। অকালিরাও ময়দানে নেমে পড়ে। দুই মাসে ৩০ হাজার গ্রেফতার করা হয়। দাবি ছিল অনন্তপুর সাহিবের প্রস্তাব পাশ করাতে হবে।

এদিকে, ১৯৮৩ সালের ৫ অক্টোবর শিখ উগ্রপন্থীরা কাপুরথালা থেকে জলন্ধরগামী একটি বাস আটকায়। বাসে থাকা হিন্দু যাত্রীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরের দিনই ইন্দিরা গান্ধী দরবার সিংহের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পাঞ্জাবে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। সরকারের অপসারণের পরেও পরিস্থিতি বদলায় না। পাঞ্জাবে হিংসা ও মারধরের ঘটনা অব্যাহত থাকে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ভিন্দ্রানওয়ালের বিরুদ্ধে কোনও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

১৯৮৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর, ভিন্দ্রানওয়ালে তার সশস্ত্র বাহিনী স্বর্ণমন্দিরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ভিন্দ্রানওয়ালে স্বর্ণমন্দিরের অকাল তখত দখল করে। আকাল তখত মানে একটি সিংহাসন যা অনন্তকালের জন্য তৈরি করা হয়। এখান থেকেই শিখ ধর্মের ফরমান জারি করা হয়। অকাল তখত দখলের বিরোধিতা ছিল, কিন্তু ভিন্দ্রানওয়ালে তাতে কর্ণপাত করেননি। ভিন্দ্রানওয়ালে চেয়েছিলেন হিন্দুরা পাঞ্জাব ছেড়ে চলে যাক। এটা ছিল দিল্লি সরকারের কাছে সরাসরি চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, ইন্দিরা গান্ধীর সমস্যা বাড়ছিল। তাদেরও একটা সিদ্ধান্তে আসতে হয়েছে।

অবশেষে ১৯৮৪ সালের ১ জুন ইন্দিরা গান্ধী পাঞ্জাবকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন। এর কোড ওয়ার্ড রাখা হয় ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। এই অভিযানের নেতৃত্ব মেজর জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশন স্বর্ণমন্দিরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল।

গত ৩ জুন অমৃতসর থেকে সাংবাদিকদের বহিষ্কার করা হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়েছে। মন্দির চত্বরে বসবাসকারীদের বাইরে আসতে বলা হয়। এই আবেদনগুলো বারবার করা হয়েছে। ৫ জুন সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মাত্র ১২৯ জন বের হয়। লোকেরা বলেছিল যে ভিন্দ্রানওয়ালের লোকেরা তাদের বাইরে আসতে বাধা দিচ্ছে।

১৯৮৪ সালের ৫ জুন সন্ধ্যা ৭টায় সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। সারা রাত দু’দিক থেকে গুলি চলে। ৬ ই জুন, ৫:২০মিনিটে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের বের করে দেওয়ার জন্য ট্যাংক স্থাপন করতে হবে। অভিযানের সময় মূল্যবান কাগজপত্র ও বইয়ের লাইব্রেরিতে আগুন ধরে যায়। গোলাগুলিতে অকাল তখতও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।

গত ৬ জুন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে গোলাগুলি। গতকাল গভীর রাতে সেনার তরফে জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের দেহ উদ্ধার করা হয়। গত ৭ জুন সকালে অপারেশন ব্লু স্টার শেষ হয়। অপারেশন ব্লু স্টারে তিন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৮৩ জন সেনা নিহত হন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ২৪৮ জন। এ নিয়ে জঙ্গি ও অন্যান্যদের মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯২ জনে।

ইন্দিরা গান্ধী যখন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী কেপি সিংদেওর কাছ থেকে অভিযানের সাফল্যের কথা জানতে পারেন, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘হে ভগবান এটা কী হয়েছে? এই লোকেরা আমাকে বলেছিল যে এত বেশি মৃত্যু হবে না।’