ভারতের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক স্থাপন করল কেরল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন শনিবার রাজ্য বিধানসভায় ঘোষণা করলেন— কেরলই দেশের প্রথম রাজ্য, যেখানে সম্পূর্ণভাবে চরম দারিদ্র্য দূর হয়েছে। কেরল পিরভি দিবসের (Kerala Piravi) বিশেষ অধিবেশনে এই ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন মুখ্যমন্ত্রী।
পিনারাই বিজয়ন বলেন, “আজকের দিনটি কেরলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কারণ, আমরা সফলভাবে এমন এক কেরল গড়েছি, যেখানে আর কোনও পরিবার চরম দারিদ্র্যের শিকার নয়। এই বিধানসভা বহু ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ও আইন প্রণয়নের সাক্ষী থেকেছে। আজ আমরা পৌঁছেছি ‘নব কেরল’ নির্মাণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে।”
২০২১ সালের অঙ্গীকার থেকে বাস্তবায়ন
মুখ্যমন্ত্রী জানান, ২০২১ সালে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পর প্রথম বৈঠকেই চরম দারিদ্র্য দূরীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেটিই আজ বাস্তব রূপ পেল। তাঁর কথায়, “এটি ছিল নির্বাচনের আগে জনগণকে দেওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, যা আমরা পূরণ করেছি।”
তবে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ বিরোধী শিবির এই দাবিকে ‘মিথ্যা প্রচার’ বলে আখ্যা দিয়ে পুরো অধিবেশন বয়কট করে। বিরোধী নেতা ভিডি সাথীসন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি পুরোপুরি প্রতারণা। বিধানসভার নিয়মের প্রতি অবমাননাকর।” এই মন্তব্যের পর ইউডিএফ বিধায়কেরা শ্লোগান দিতে দিতে সভা ত্যাগ করেন।
জবাবে মুখ্যমন্ত্রী পাল্টা কটাক্ষ করেন, “যাঁরা প্রতারণার কথা বলছেন, আসলে তাঁরা নিজেদের আচরণের কথাই বলছেন। আমরা যা বলি, তা বাস্তবায়ন করি— সেটাই আমাদের জবাব।”
কীভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হল কেরল Kerala Extreme Poverty Eradication
পড়ুয়াদের শতভাগ সাক্ষরতা, ডিজিটাল সাক্ষরতা ও পূর্ণ বিদ্যুতায়নের সাফল্যের পর কেরল এবার ‘চরম দারিদ্র্যমুক্ত’ রাজ্যের তকমা অর্জন করল। এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে সরকারের বিস্তৃত Extreme Poverty Eradication Programme (EPEP)— এক হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগে পরিচালিত এই কর্মসূচিতে রাজ্যজুড়ে সূক্ষ্ম পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী—
- ২০,৬৪৮টি পরিবারকে প্রতিদিন খাদ্যের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ২,২১০ পরিবারকে সরাসরি রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়।
- ৮৫,৭২১ জনের চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ বহন করেছে সরকার।
- ৫,৪০০-র বেশি নতুন ঘর তৈরি বা নির্মাণাধীন, ৫,৫২২টি ঘর মেরামত করা হয়েছে, এবং ২,৭১৩টি ভূমিহীন পরিবারকে জমি দেওয়া হয়েছে।
- ২১,২৬৩ জন প্রথমবারের মতো রেশন কার্ড, আধার, পেনশনসহ প্রয়োজনীয় নথি পেয়েছেন।
- ৪,৩৯৪টি পরিবারকে জীবিকা সংক্রান্ত প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে।
পিনারাই বিজয়ন জানান, সরকারের লক্ষ্য ছিল “এক ছাঁচে গড়া প্রকল্প” নয়, বরং প্রতিটি পরিবারের প্রয়োজন অনুযায়ী ৬৪,০০৬টি দুর্বল পরিবারকে শনাক্ত করে পৃথক মাইক্রো-প্ল্যান তৈরি করা।
সমন্বিত উদ্যোগে সাফল্য
স্থানীয় প্রশাসনমন্ত্রী এম বি রাজেশ জানান, এই কর্মসূচি রাজনৈতিক সীমানা পেরিয়ে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত হয়েছে। এলডিএফ ও ইউডিএফ উভয় শাসিত স্থানীয় সংস্থার সহযোগিতায় কেরলজুড়ে প্রকল্পটি চালানো হয়।
মন্ত্রী বলেন, “এটা এমন নয় যে এক সকালে হঠাৎ ঘোষণা করে দিলাম, কেরল দারিদ্র্যমুক্ত। এটি বহু বছরের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফল।”
কেরলের এই সাফল্য শুধু রাজ্যের প্রশাসনিক দক্ষতারই প্রতিফলন নয়, বরং এক নয়া দৃষ্টান্ত— যেখানে সরকারি নীতি, স্থানীয় সংস্থা এবং জনসম্পৃক্ততা মিলেই নির্মাণ করেছে এক ‘নব কেরল’, দারিদ্র্যমুক্ত, সুশাসিত এবং আত্মনির্ভর।


