পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ রাষ্ট্রসংঘের একটি সম্মেলনে ভারতের ইন্দাস জল চুক্তি (indus-water-treaty) স্থগিত করার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার পর, ভারত শনিবার (৩১ মে, ২০২৫) তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ভারত এই সমালোচনাকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, পাকিস্তানের অব্যাহত সীমান্ত জুড়ে সন্ত্রাসবাদ এই চুক্তির বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে।
তাজিকিস্তানে হিমবাহ সংরক্ষণ বিষয়ক রাষ্ট্রসংঘ সম্মেলনে শরিফের মন্তব্যের জবাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিং বলেছেন, পাকিস্তান নিজেই সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে চুক্তি লঙ্ঘন করছে।
পটভূমি: পহেলগাঁও হামলা এবং চুক্তি স্থগিত (indus-water-treaty)
১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দাস জল চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ইন্দাস নদী (indus-water-treaty)ব্যবস্থার জল ভাগাভাগি নিয়ন্ত্রণ করে। এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ এবং অসংখ্য দ্বন্দ্বের মধ্যেও টিকে ছিল। তবে, ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিদের হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর ভারত চুক্তিটি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত জুড়ে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে আসছে, যা ভারতের বিরুদ্ধে একটি প্রক্সি যুদ্ধের অংশ। এই হামলার পর ভারত একাধিক কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইন্দাস জল চুক্তি স্থগিত করা, অটারি-ওয়াগাহ সীমান্ত বন্ধ করা, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা ছাড় নীতি বাতিল এবং দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার।
শেহবাজ শরিফের বক্তব্য
তাজিকিস্তানে রাষ্ট্র সংঘ সম্মেলনে শেহবাজ শরিফ ইন্দাস জল চুক্তি (indus-water-treaty) স্থগিত করাকে ‘জলের অস্ত্রীকরণ’ এবং ‘ভারতের একতরফা ও অবৈধ সিদ্ধান্ত’ বলে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য জিম্মি করা যায় না।
পাকিস্তান এটি মেনে নেবে না। আমরা আমাদের লাল রেখা অতিক্রম করতে দেব না।” তিনি এই সিদ্ধান্তকে পাকিস্তানের কৃষি ও জ্বালানি খাতের জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন, কারণ ইন্দাস নদী ব্যবস্থার জল পাকিস্তানের ৮০% কৃষি এবং এক-তৃতীয়াংশ জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিং শরিফের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করে বলেন, “পাকিস্তান এই মঞ্চের অপব্যবহার করে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। আমরা এই প্রচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ের তুলনায় পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, জনসংখ্যার পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সীমান্ত জুড়ে সন্ত্রাসবাদের অব্যাহত হুমকি। তিনি বলেন, “পাকিস্তানের অব্যাহত সন্ত্রাসবাদ চুক্তির বিধান অনুযায়ী এটি কার্যকর করার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছে। পাকিস্তান নিজেই চুক্তি লঙ্ঘন করছে, তাই তাদের উচিত ভারতের উপর দোষ চাপানো থেকে বিরত থাকা।”
মন্ত্রী আরও বলেন, চুক্তির (indus-water-treaty)প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এটি সদিচ্ছা ও বন্ধুত্বের চেতনায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাই, সৎভাবে চুক্তি মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। তিনি পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানান, সীমান্ত জুড়ে সন্ত্রাসবাদের সমর্থন বন্ধ না করা পর্যন্ত চুক্তি স্থগিত থাকবে।
ইন্দাস জল চুক্তির তাৎপর্য
ইন্দাস জল চুক্তি ১৯৬০ সালে বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয়। এটি ভারতকে পূর্বাঞ্চলীয় নদী—রাভি, বিয়াস ও সতলুজ—এর নিয়ন্ত্রণ দেয়, যার বার্ষিক প্রবাহ প্রায় ৪১ বিলিয়ন ঘনমিটার। পাকিস্তান পায় পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী—ইন্দাস, ঝিলাম ও চেনাব—যার বার্ষিক প্রবাহ ৯৯ বিলিয়ন ঘনমিটার, অর্থাৎ মোট জলের ৭০%। এই চুক্তি পাকিস্তানের কৃষি ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের স্থগিতকরণের (indus-water-treaty) ফলে পাকিস্তানের জল প্রবাহে তাৎক্ষণিক প্রভাব না পড়লেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি পাকিস্তানের কৃষি ও অর্থনীতির উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের কাছে বর্তমানে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলির বিপুল পরিমাণ জল ধরে রাখার মতো অবকাঠামো নেই। তবে, ভারত এখন জলাধার থেকে পলি নিষ্কাশন বা জল প্রবাহের তথ্য না দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিতে পারে, যা পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তান এই স্থগিতকরণকে ‘যুদ্ধের কাজ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে, জল প্রবাহ বন্ধ বা পরিবর্তন করা হলে তারা পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এই পদক্ষেপকে ‘একতরফা ও অবৈধ’ বলে সমালোচনা করেছে। তারা বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং স্থায়ী সালিসি আদালতে এই ইস্যুতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
শর্মিষ্ঠা গ্রেফতার আবহে এবার মুখোমুখি পবন-মমতা
ভারতের অবস্থান
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, “ইন্দাস জল চুক্তি সদিচ্ছা ও বন্ধুত্বের চেতনায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পাকিস্তান দশকের পর দশক ধরে সীমান্ত জুড়ে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে এই চেতনাকে লঙ্ঘন করেছে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, “সন্ত্রাসবাদ এবং আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না। জল ও রক্ত একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না।” ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলেছেন, “পাকিস্তান যতক্ষণ না সন্ত্রাসবাদের সমর্থন বন্ধ করে, ততক্ষণ চুক্তি স্থগিত থাকবে।”
ইন্দাস জল চুক্তির (indus-water-treaty) স্থগিতকরণ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের একটি নতুন উত্তেজনার সূচনা করেছে। এটি দুই দেশের মধ্যে জল-রাজনীতি, কৃষি নির্ভরতা এবং ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ভারতের দাবি, পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড এই চুক্তির চেতনাকে ক্ষুণ্ন করেছে, যখন পাকিস্তান এটিকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে। এই বিতর্ক আন্তর্জাতিক মঞ্চে কীভাবে সমাধান হবে, তা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।