সিপিআই(এম)-এর প্রবীণ নেতা প্রকাশ কারাত বলেছেন, বিরোধী দলগুলির ‘ইন্ডি’ জোট লোকসভা নির্বাচনের জন্য গঠিত হয়েছিল, রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের জন্য নয়। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির একটি বিস্তৃত মঞ্চ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। কারাতের মতে, এই জোটকে আরও বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত, যাতে এটি কেবল নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। তাঁর এই বক্তব্য ভারতীয় রাজনীতিতে বিরোধীদের ভবিষ্যৎ কৌশল নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’ (ইন্ডিয়া) নামে পরিচিত এই জোটটি গত বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে গঠিত হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ)-এর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিরোধী মোর্চা তৈরি করা। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআই(এম), সিপিআই, সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি সহ একাধিক দল এই জোটের অংশ। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই জোট উল্লেখযোগ্যভাবে ২৩৪টি আসন জিতেছিল, যদিও বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ ২৯৩টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে।
প্রকাশ কারাত শনিবার নয়াদিল্লিতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “ইন্ডি জোট লোকসভা নির্বাচনের জন্য গঠিত হয়েছিল। এটি কোনওভাবেই রাজ্য নির্বাচনের জন্য ডিজাইন করা হয়নি।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, প্রতিটি রাজ্যে বিরোধী দলগুলির আঞ্চলিক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য আলাদা। তাই রাজ্য নির্বাচনে এই জোটের কাঠামো প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম) একে অপরের বিরোধী, কিন্তু লোকসভায় তারা ইন্ডি জোটের অংশ হিসেবে একসঙ্গে কাজ করেছে।
কারাত আরও বলেন, “আমাদের একটি বৃহত্তর ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী মঞ্চ দরকার, যা কেবল নির্বাচনী জয়-পরাজয়ের উপর নির্ভর করবে না। এই জোটকে একটি আদর্শগত ভিত্তি দেওয়া উচিত, যাতে এটি বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী লড়াই চালাতে পারে।” তিনি মনে করেন, নির্বাচনী রাজনীতির সংকীর্ণতা এই জোটের সম্ভাবনাকে সীমিত করে দিতে পারে।
ইন্ডি জোট গঠনের পর থেকে এটি লোকসভায় বিজেপির আধিপত্য কমাতে সফল হয়েছে। তবে, রাজ্য নির্বাচনে এই জোটের দলগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস এবং শিবসেনা (উদ্ধব গোষ্ঠী) একসঙ্গে কাজ করলেও, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এবং বামফ্রন্টের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। কারাতের এই মন্তব্য এই বাস্তবতার প্রতিফলন। তিনি বলেন, “রাজ্যে আমাদের আলাদা লড়াই আছে। তবে জাতীয় স্তরে বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব এবং প্রয়োজনীয়।”
কারাতের এই বক্তব্যকে অনেকে পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত করে দেখছেন। ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল, কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের মধ্যে জোট নিয়ে জল্পনা চলছে। তবে, কারাত স্পষ্ট করেছেন যে, ইন্ডি জোটের কাঠামো রাজ্যে প্রযোজ্য নয়।
কারাতের প্রস্তাবিত ‘বৃহত্তর ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চ’ ধারণাটি বিরোধী দলগুলির মধ্যে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেন, “বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা এবং অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে লড়তে হলে আমাদের একটি শক্তিশালী বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে।” তবে, এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য জোটের দলগুলির মধ্যে সমন্বয় এবং আদর্শগত ঐক্য প্রয়োজন, যা বর্তমানে চ্যালেঞ্জিং।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “ইন্ডি জোট একটি গতিশীল প্ল্যাটফর্ম। আমরা লোকসভায় সাফল্য পেয়েছি এবং ভবিষ্যতেও এটি শক্তিশালী হবে।” তবে, তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে এখনও কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি।
কারাতের এই মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একজন বিশ্লেষক বলেন, “ইন্ডি জোট লোকসভায় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু রাজ্যে এটি প্রযোজ্য না হলে জোটের ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।” অন্যদিকে, কেউ মনে করেন, ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে একটি বৃহৎ মঞ্চ ভবিষ্যতে বিরোধীদের শক্তি বাড়াতে পারে।
প্রকাশ কারাতের বক্তব্য ইন্ডি জোটের উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। লোকসভা নির্বাচনে সাফল্যের পর এই জোট কীভাবে এগিয়ে যাবে, তা নির্ভর করছে বিরোধী দলগুলির ঐক্য এবং কৌশলের উপর। ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধীদের একটি বিস্তৃত মঞ্চ গড়ে ওঠা সময়ের দাবি হলেও, এর বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, তা ভবিষ্যতেই স্পষ্ট হবে। আপাতত, কারাতের এই আহ্বান বিরোধী রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে।