Pataliputra: মাওবাদীদের বাপ-ঠাকুর্দারা হাত মেলাল, পাটলিপুত্রের ইতিহাসে শুরু অন্য যুদ্ধ

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান চলছে। পাটনায় (Pataliputra)  কুচকাওয়াজে স্যালুট দিলেন মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ি দেবী। হৈ হৈ পড়ে গেল। বিহার পুলিশের তাবড় তাবড় কর্তারা ঘিরে থাকলেন…

Pataliputra: মাওবাদীদের বাপ-ঠাকুর্দারা হাত মেলাল, পাটলিপুত্রের ইতিহাসে শুরু অন্য যুদ্ধ

প্রসেনজিৎ চৌধুরী:
প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান চলছে। পাটনায় (Pataliputra)  কুচকাওয়াজে স্যালুট দিলেন মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ি দেবী। হৈ হৈ পড়ে গেল। বিহার পুলিশের তাবড় তাবড় কর্তারা ঘিরে থাকলেন ‘ম্যাডাম সিএম’ কে। কয়েকদিন আগেও তিনি দেহাতি মহিলা। রোটি পাকানো আর গোয়াল দেখাশোনা করেই খুশি ছিলেন। চারাঘোটালা (পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি) মামলায় স্বামী লালুপ্রসাদ যাদব তখন খাবি খাচ্ছেন। হাল বুঝে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে স্ত্রীকেই সিএম বানিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখলেন আড়াল থেকে। ক্ষমতায় এসেই রাবড়ি দেবী চমকে দিলেন তাঁর আচরণে। সে এক দৃশ্য। দিন তো ভালোয় ভালোয় কাটল। আমলারা সবাই ম্যাডাম ম্যাডাম করছে। স্যালুট ঠুকছে পুলিশ। রাবড়ি দেবী সেসব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন। পাটনার অ্যান্নে মার্গের সেই বাড়ির মূল দরজার সামনে নাম ফলকে লালুপ্রসাদের জায়গায় রাবড়ি দেবী বসে গেছে।  সবই চলছে আমলাতান্ত্রিক পথে।

কিন্তু পাটনা থেকে অনেক দূরে ভয়াবহ রাত নামল জেহানাবাদ জেলার সাঁখারিবিঘা গ্রামে। রাত সাড়ে দশটার কিছু পরের ঘটনা। গুলির ঝড় বয়ে গেল। আবার গণহত্যা। আবার দেশ জুড়ে আলোড়ন।

১৯৯৯ সালের ২৬ জানুয়ারির এই রক্তাক্ত রাতের পর সাঁখারিবিঘার চামার সম্প্রদায় শুধু একটাই অনুগ্রহ চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ি দেবীর কাছে- ক্ষতিপূরণ লাগবে না। বন্দুক দিন। মুখ্যমন্ত্রীর সিকিউরিটি  অফিসাররা ফের বুঝলেন ‘ইস রাত কি সুবহ নেহি’ (এ রাতের সকাল হয় না)। এবার আর একটা গণহত্যা ঘটবে।

সাঁখারিবিঘা গ্রামের রাস্তা, বাড়ির উঠোন, উনুনের পাশে পড়ে থাকা মৃতদেহ ঘিরে জমে উঠছিল ক্ষোভ। গোনাগুণতি শেষে দেখা গেল রণবীর সেনা এবার ২২ জন নিম্নবর্গের ‘শত্রু’ নিকেশ করেছে।  রণবীর সেনার মুখিয়া ব্রহ্মেশ্বর সিং দিয়েছিল খতমের নির্দেশ।

সাঁখারিবিঘায় একটার পর একটা মৃতদেহ আগুনে পুড়ছে। শোন নদীর হু হু করে আসা হাওয়ার তোড়ে চিতার কাঠগুলো কট কট করে ফাটছিল। রণবীর সেনা প্রধান ব্রহ্মেশ্বর সিং বদলা নিয়েছে। তাদের প্রেস রিলিজ ঘিরে পাটনায় তুমুল শোরগোল। দিল্লি সহ গোটা দেশে ফের বিহারকে নিয়ে সরগরম। বিরোধী জনতা দল ও সব বামপন্থী দলগুলির ডাকা বনধে স্তব্ধ হয়ে গেল বিহার।

সাঁখারিবিঘার গণহত্যার পর থেকে পুরো ১৯৯৯ সাল জুড়ে রক্তগঙ্গা বয়ে গেছিল বিহারে। কখনো  বন্দুকের নল ঘুরে গেছে উঁচু জাতের ভূমিহারদের দিকে। কখনো গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছে দলিতরা।  দেশজুড়ে আতঙ্কের নাম জেহানাবাদ। বিহারের এই জেলা যেন গণহত্যার জমি!

একনজরে ১৯৯৯ বিহারের পরিস্থিতি: (জেহানাবাদ ও বক্সার জেলা)

  • নারায়ণপুরে রণবীর সেনার হামলায় নিহত ১১ দলিত
  • উশ্রি বাজারে লিবারেশন হামলায় মৃত ৭ উচ্চবর্ণ
  • ভীম পাড়ায় জনযুদ্ধ গোষ্ঠির হামলায় মৃত ৪ উচ্চবর্ণ
  • সেনারি গ্রামে এমসিসি হামলায় নিহত ৩৫ উচ্চবর্ণ
  • সুজাতপুর পুলিশের অভিযানে নিহত ১৬ লিবারেশন সদস্য
  • সেন্দানি গ্রামে রণবীর সেনার হামলায় মৃত ১২ দলিত

পরপর গণহত্যার ঘটনাগুলি দেখলে একটি বিষয় স্পষ্ট উচ্চবর্ণের রণবীর সেনা আর নিম্নবর্ণের রক্ষাকারী সশস্ত্র অতি বাম সংগঠনগুলি (লিবারেশন, এমসিসি ও জনযুদ্ধ) বদলা নিতে মরিয়া হয়। আর তৃতীয়পক্ষ অর্থাৎ পুলিশও তার বন্দুক গর্জন শুরু করে। তবে সেই গুলি রনবীর সেনার দিকে তাক করে নয়!

বিহারের কিংবদন্তি অতিবামপন্থী নেতা বিনোদ মিশ্র নিয়েছিলেন ‘আঁখ কে বদলে আঁখ’ নীতি। তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক মতে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও সবকটি অতি বাম দল এই নীতি মেনে নেয়। আবার তাদের পরস্পরের প্রতি গুলি চালানোতে খামতি ছিল না। প্রবল ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবন বিনোদ মিশ্রের। গুলি-বন্দুকের সঙ্গেই ঘুমোতেন তিনি। এই সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন নেতার নামে রণবীর সেনা থমকে গেছে বারবার। ১৯৯৮ সালে বিনোদ মিশ্রের বহু আলোচিত জীবন শেষ হয় হার্ট অ্যাটাকে। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে নীরব থাকলেন বিহারের কিংবদন্তি  কমিউনিস্ট নেতা (সিপিআই) চতুরানন মিশ্র। তিনি ছিলেন দেবেগৌড়া মন্ত্রিসভার কৃষিমন্ত্রী।

বিনোদ মিশ্রের মৃত্যুর পরেই সবথেকে বড় গণহত্যায় নিম্ন শ্রেণির লাসে ভরে গেছিল জেহানাবাদের সাঁখারিবিঘা। রণবীর সেনার প্রধান ব্রহ্মেশ্বর সিংয়ের ভয়ঙ্কর এই হামলার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আরো এক গণহত্যার কেন্দ্র জেহানাবাদ জেলার সেনরাই গ্রাম। এবার অতিবাম সংগঠন এমসিসি হামলায় দেশ স্তম্ভিত। গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে উঁচু জাতের দেহ। গুলিতে ঝাঁঝরা ৩৫ জনের মৃতদেহ শনাক্তকরণের পর প্রবল বিক্ষোভের মাঝে সরকারি আধিকারিকরা সেনরাই গ্রাম ছাড়লেন। ফের বদলার আগুন জ্বলে উঠল ব্রহ্মেশ্বর সিংয়ের চোখে।

এরপর একের পর এক গণহত্যা বিহারের বিশেষ পরিচয় হয়ে যায়। কখনো দলিতদের হয়ে জনযুদ্ধ ও এমসিসি দলের আক্রমণ তো কখনো রণবীর সেনার হামলা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হচ্ছিল।  এই পরিস্থিতি  আরও এক রাজনৈতিক প্রশ্ন এনে দিল বিহারের মাটিতে সশস্ত্র অতিবাম সংগঠনগুলির কাছে। এদের দুই প্রধান শক্তি এমসিসি (MCC) ও জনযুদ্ধ  (PWG)  নেতৃত্ব নিজেদের এক ছাতার তলায় আনার পথে এগোলেন। ২০০৪ সালে হায়দরাবাদে এমসিসি ও জনযুদ্ধ গোষ্ঠি এক হয়ে সিপিআই (মাওয়েস্ট) জন্ম নিল। যে মাওবাদীদের হামলার খবর পান এখন, বিহার থেকেই তাদের বাপ-ঠাকুর্দা অর্থাৎ পূর্বসূরীদের পথ চলা শুরু।

Advertisements

**** ****        **** ****            **** **** 

২০১২ সালের ১ জুন। সকালবেলা। ভোজপুরের আরা শহরে শীর্ণকায় ব্রহ্মেশ্বর সিং মর্নিং ওয়াক শেষে বাড়ি ফিরছে।
– নমস্তে মুখিয়াজি?
চমকে তাকাতেই শুরু হয় গুলির ফোয়ারা। রাস্তার উপরেই পড়ে থাকল রণবীর সেনার মুখিয়াজির দেহ। বদলা নিল মাওবাদীরা।  ব্রহ্মেশ্বর সিং হত্যার সংবাদে সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি।বিহার রেলপথে বিচ্ছিন্ন। আরা শহর জ্বলছিল। পাটনা-ধানবাদের লাইনে বহু ট্রেনে ভাঙচুর হচ্ছে। কয়েকদিন বিহার প্রায় বিচ্ছিন্ন। ভোজপুর জেলার সেই  আইনশৃঙ্খলা বিহীন পুরনো ছবি।

গণহত্যার রেশ, পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির জেরে রাজনৈতিক টালমাটালে বিহারে সরকারের পরিবর্তন হয়। উত্থান পতনের রেশ কাটিয়ে পাকাপোক্ত ভাবে ক্ষমতায় এলেন নীতীশ কুমার।  মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ‘সুশাসন বাবু’ হিসেবে সুনাম কুড়িয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু জ্বলতে থাকা আরা শহর বলে দিচ্ছিল  ‘অন্ত নেহি, ফির শুরু কাহানি’।

বিহারের প্রেক্ষিতে গত পাঁচ দশকের পুরনো ভারতের জাতিবাদ ভিত্তিক গণহত্যা ও আজকের মাওবাদীদের পূর্বসূরীদের খুঁজতে গিয়ে বেশকয়েকটা রক্তাক্ত পাতা উল্টে দেখলাম। এটা ঠিক নীতীশ কুমারের শাসনেই ‘জঙ্গলরাজ’ শেষ হয়েছে। কিন্তু বে-রোজগারির উঁচু সূচকে লাখো পরিযায়ী শ্রমিকের আবাসভূমি বিহার রোজগারের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। আর জাতিবাদ আছে নিজের জায়গায়-নিজ মহিমায়। 

“कल ही तो कहा था
मगधवासियों ने
मगध मत छोड़ो
मैंने दिया था वचन –
सूर्योदय के पहले
लौट आऊँगा”-  শ্রীকান্ত ভার্মা

পাটলিপুত্রের যুদ্ধ শেষ করলাম। দেখা হবে অন্য কোনো যুদ্ধে। 

গত পর্বPataliputra: পুরুলিয়ার মাঠে,ঝোপে পড়েছিল হাজার হাজার গুলি-এ কে ৪৭, কিম ডেভির বন্ধু ছিল পাপ্পু