প্রসেনজিৎ চৌধুরী:
ওয়ারেন্ট এগিয়ে দিলেন আর কে সিং (পরে বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী)। মৃদু হেসে সেটা নিলেন লালকৃষ্ণ আদবানী। থেকে থেকে গগন বিদারী স্লোগানে কাঁপছে চারিদিক। বিহার পুলিশ প্রস্তুত যে কোনো পরিস্থিতি রুখতে। হাসি মুখে আদবানী গ্রেফতার হলেন।সমস্তিপুরে থেমে গেল রাম রথ। ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবরে বিহার থেকে ভারতের রাজনীতি ফের মোড় নিল। জঙ্গলরাজ বিতর্কে তীব্র সমালোচিত লালুপ্রসাদ যাদব এবার রাজনৈতিক কৌলিন্য পেলেন আদবানীর রথ আটকে। পাটলিপুত্রের (Pataliputra) রাজনীতিতে এ দৃশ্য চিরন্তন হয়ে থেকে গেল।
বিজেপির রাজনৈতিক লক্ষ্য অযোধ্যায় রাম জন্মভূমির শিলা পূজা। সেই লক্ষ্যে রথ বের করে প্রচার করছিলেন আদবানী। সংঘ পরিবারের চরম প্রতিপক্ষ কমিউনিস্ট পার্টি। সিপিআইএমের দাপট তখন পশ্চিমবঙ্গে প্রবল। সেই সময় আদবানির সেই রাম রথ পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে পার হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বিশেষ কূট পরামর্শে তাঁর গুণমুগ্ধ লালু প্রসাদ যাদব বিহারে রথটি আটকে দিলেন। দেশ জুড়ে শোরগোল পড়ে গেল। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক আগুন হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল। কোথাও একটা অশান্তির মেঘ জমাট বাধছে তার শুরুটা হলো আদবানির রাম রথ আটকে দেওয়ায়। গোটা দেশে একমাত্র বিহারেই এসে বাধা পেয়েছিলেন আদবানি।
“ऐ क़ाफ़िले वालों, तुम इतना भी नहीं समझे
लूटा है तुम्हे रहज़न ने, रहबर के इशारे पर”
– তরন্নম কানপুরি
সে এক রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাপূর্ণ সময়। রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণ স্পষ্ট হচ্ছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় এর ভয়াবহ পরিণতি দেখল বিশ্ববাসী। উন্মত্ত করসেবকদের হামলায় ভেঙে পড়ল বাবরি মসজিদ। তাৎপর্যপূর্ণ, কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস সরকার। বারবার আমলারা প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওকে বাবরি ধংস আটকানের বার্তা পাঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নীরবে উপাসনায় মগ্ন ছিলেন। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির শাসন থাকলেও সেনা নামিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেননি প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও। দুনিয়া স্তম্ভিত। বাবরি মসজিদ ধংসের এই সময়টিতে বিহারের রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণের অন্তরালে শাখা উপশাখা বিশিষ্ট জটিল জাতিভিত্তিক বিভেদ আরো খারাপ হচ্ছিল। এই কারণেই পুরো নব্বই দশক জুড়ে একের পর এক ভয়াবহ গণহত্যার কেন্দ্র-বিহার। এখান থেকেই জন্ম নিচ্ছে রক্তচরিত্রের একটি ভয়াবহ নাম- ব্রহ্মেশ্বর সিং।
ছিপছিপে চেহারা। ধুতি পাঞ্জাবি পরা ভাঙাচোরা মুখ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পাঞ্জাবির বুক পকেটে কিছু কাগজে কয়েকটা গ্রামের নাম লেখা থাকে। অনেক রাতে ভোজপুর জেলার আরা শহরের ছোট্ট ঘরে লণ্ঠণের হলদে আলোয় গ্রামের নামগুলো দেখতে দেখতে প্রতিহিংসায় চোখ জ্বলে ওঠে ব্রহ্মেশ্বর সিংয়ের। উঁচু জাতের ভূমিহার এই নেতার নির্দেশে বহুবার বিহার রক্তাক্ত হয়েছে। রণবীর সেনার ‘মুখিয়াজি’ বার বার বদলা নিয়েছে স্বজাতির হয়ে। দলিত নিচু শ্রেণী মানেই অস্পৃশ্য। এদের নেতৃত্বে থাকা মাওয়েস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার(এমসিসি), জনযুদ্ধ, সিপিআই(এম-এল) তার শত্রু। আর দুটি মূল স্রোতের লাল পার্টি সিপিআই, সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক সংঘর্ষেরও সে প্রবল বিরোধী। উঁচু জাতের হয়ে সশস্ত্র হামলার দিকটি ব্রহ্মেশ্বর সিংয়ের মূল লক্ষ্য। বিহারে অতিবামপন্থী সংগঠনগুলির নেতৃত্বে যেভাবে নিচু শ্রেণীর মানুষ বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে বহু অত্যাচারের বিরুদ্ধে উঁচু জাতির রক্ত ঝরাচ্ছিল, তারই বদলা নিতে ১৯৯৪ সালে ভোজপুরে তৈরি হয় রণবীর সেনা। এর পরেই আঘাত-প্রত্যাঘাতের রণভূমিতে পরিণত হয় বিহার।
গভীর রাতে ভারি পাল্লা দেওয়া দরজার পিছনে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে চিরকুটের একটি গ্রামে ঢ্যাঁরা দেয় মাস্টার ব্রহ্মেশ্বর। সেই চিরকুট হাত ঘুরে নির্দিষ্ট গোষ্ঠির কাছে পৌঁছে যায়। তারপর সংঘঠিত হয় মারাত্মক ঘটনা। বদলা। যেমনটা ঘটেছিল বাথানিটোলায় ১৯৯৬ সালের ১১ জুলাই।
বাথানিটোলা গ্রামটা খুবই সাধারণ। দলিত নিম্নবর্গীয়দের বসবাস। একটা খোলামুখ কুয়ো পেরিয়ে গেলে রাস্তাটা যেখানে ধাক্কা খায় গুলির শব্দ ওখানেই শোনা গেল। রাইফেল কাঁধে একের পর এক হামলাকারী ঢুকতে শুরু করেছে বাথানিটোলায়। ভয়ে দরজা বন্ধ করেছে সবাই। গ্রাম ঘিরে নিয়েছে রণবীর সেনা। সবকটা ঘরের দরজায় পড়ছে লাথি। ভেঙে পড়ছে একটার পর একটা ঘরের পলকা দরজা। বাইরে সারি সারি বন্দুক তৈরি। বেশি অপেক্ষা নয়, একেবারে গুলির ঝড় চলল। কে মরছে বড় কথা না। দলিত মরছে এটাই বড় কথা রণবীর সেনার কাছে। গণহত্যার আরো এক কেন্দ্র বাথানিটোলা। পড়ে থাকা মৃতদেহের মধ্যে শিশুদের মাথা গুঁড়িয়ে গেছে বুলেটে। ছোট বড় কোনো বাছাবাছি নেই। ‘বদলা’ নিচ্ছে ভূমিহার।
এই প্রথম উঁচু জাতের তৈরি ভাড়াটে বাহিনী রণবীর সেনা প্রথম ভয়ানক রূপ দেখাল। বাথানিটোলায় শিশু, মহিলা সহ ২১ জন দলিতের গুলিবিদ্ধ দেহগুলো দেখে ভোজপুরের পুলিশ কর্তারা বুঝলেন, কেন বারবার ‘বদলা’ শব্দ জোর দিয়ে বলছিল বারা গ্রামে নিহত ভূমিহারদের আত্মীয়রা। দেশ জুড়ে প্রবল আলোচনা হচ্ছিল এই বাথানিটোলা গণহত্যা।
বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। এলো প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি। বিহারের অতি আলোচিত সিপিআই (এম-এল) নেতা বিনোদ মিশ্র বদলার নির্দেশ দিলেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা, বারবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে জীবন কেটেছে এই অতিবাম নেতার। বিহার তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক কর্মভূমি। ( চলবে)
গত পর্ব: Pataliputra: রাজপুতদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে হরিজনদের চোখ জ্বলছিল, প্রত্যাঘাতে জন্মাল রণবীর সেনা