কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনভোগীদের জন্য অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। এই কমিশনের গঠন এবং এর সম্ভাব্য সুপারিশ নিয়ে কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের মধ্যে একটি প্রধান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে: মহার্ঘ ভাতা (Dearness Allowance, DA) কি মূল বেতনের সঙ্গে একীভূত হবে? এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন, যা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের আর্থিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবন্ধে আমরা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করব।
অষ্টম বেতন কমিশনের পটভূমি
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের অনুমোদন দিয়েছে। এই কমিশনের লক্ষ্য হলো কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশন কাঠামো সংশোধন করা। সপ্তম বেতন কমিশনের মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে, এবং অষ্টম বেতন কমিশন ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, কমিশনের শর্তাবলী (Terms of Reference, ToR) এখনও চূড়ান্ত হয়নি, এবং এই শর্তাবলীতে মহার্ঘ ভাতার একীভূতকরণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে।
মহার্ঘ ভাতা একীভূতকরণের প্রেক্ষাপট
মহার্ঘ ভাতা হলো মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের দেওয়া একটি ভাতা। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে এই ভাতা ৫০% থেকে বেড়ে ৫৫% হয়েছে। কিছু সূত্রে জানা গেছে যে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে এটি ৬৬% পর্যন্ত উঠতে পারে। পঞ্চম বেতন কমিশনের সময় মহার্ঘ ভাতা মূল বেতনের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছিল, যার ফলে মূল বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছিল। তবে, ষষ্ঠ এবং সপ্তম বেতন কমিশনে এই প্রথা বন্ধ করা হয়। ফলে, কর্মচারী ইউনিয়নগুলি দীর্ঘদিন ধরে মহার্ঘ ভাতা একীভূতকরণের দাবি জানিয়ে আসছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
১. শিব গোপাল মিশ্র, সেক্রেটারি, জাতীয় পরামর্শদাতা JCM: শিব গোপাল মিশ্র, যিনি কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন, বলেন, “মহার্ঘ ভাতা একীভূত করা হলে বেতন কাঠামো আরও সরল হবে এবং কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা বাড়বে।” তিনি জানান, JCM ইতিমধ্যে অষ্টম বেতন কমিশনের শর্তাবলীতে এই প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। তবে, তিনি সতর্ক করে বলেন, “সরকারের আর্থিক বোঝা বাড়তে পারে, তাই এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর।”
২. অর্থনীতিবিদ ড. প্রণব সেন: প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. প্রণব সেন মনে করেন, মহার্ঘ ভাতা একীভূত করা অর্থনৈতিকভাবে সম্ভব হলেও এটি সরকারের আর্থিক নীতির ওপর নির্ভর করবে। তিনি বলেন, “ভারত সরকার বর্তমানে রাজস্ব ঘাটতি কমানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। মহার্ঘ ভাতা একীভূত করলে সরকারের ব্যয় বছরে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা বাড়তে পারে। তবে, এটি কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “এই সিদ্ধান্তের জন্য সরকারকে আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং মুদ্রাস্ফীতির হারের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে।”
৩. প্রাক্তন অর্থ সচিব সুভাষ চন্দ্র গর্গ: সুভাষ চন্দ্র গর্গ মনে করেন, মহার্ঘ ভাতা একীভূত করার সম্ভাবনা কম। তিনি বলেন, “সপ্তম বেতন কমিশনে মহার্ঘ ভাতা আলাদা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, কারণ এটি সরকারের আর্থিক বোঝা নিয়ন্ত্রণে রাখে। অষ্টম বেতন কমিশনেও এই নীতি অব্যাহত থাকতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “তবে, ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর বাড়িয়ে কর্মচারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হতে পারে।”
কর্মচারীদের প্রত্যাশা
জাতীয় পরামর্শদাতা যন্ত্রপাতি (JCM) এবং অন্যান্য কর্মচারী ইউনিয়ন মহার্ঘ ভাতা একীভূতকরণের পক্ষে সোচ্চার। তাদের যুক্তি, এটি বেতন কাঠামোকে সরল করবে এবং পেনশনভোগীদের জন্যও সুবিধাজনক হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি মহার্ঘ ভাতা একীভূত হয়, তবে সর্বনিম্ন মূল বেতন (বর্তমানে ১৮,০০০ টাকা) ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকায় উন্নীত হতে পারে। এছাড়া, ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ থেকে ৩.০ পর্যন্ত হতে পারে, যা মধ্য-স্তরের কর্মচারীদের মাসিক বেতন ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা বাড়াতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
মহার্ঘ ভাতা একীভূত করলে সরকারের উপর আর্থিক চাপ বাড়বে। গোল্ডম্যান স্যাক্সের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পদক্ষেপে সরকারের বার্ষিক ব্যয় ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে, এটি কর্মচারীদের হাতে বাড়তি আয় তুলে দেবে, যা ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে। অপরদিকে, অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন যে এটি মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে, যা সাধারণ মানুষের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
সরকারের অবস্থান
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কিছু সূত্রে জানা গিয়েছিল যে সরকার মহার্ঘ ভাতা একীভূত করার পক্ষে নয়, কারণ এটি আর্থিক বোঝা বাড়াবে। তবে, অষ্টম বেতন কমিশনের শর্তাবলী এখনও চূড়ান্ত হয়নি, তাই এই বিষয়ে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও অজানা।
মহার্ঘ ভাতা মূল বেতনের সঙ্গে একীভূত হবে কিনা, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কর্মচারী ইউনিয়নগুলি এই দাবিতে সোচ্চার হলেও, সরকারের আর্থিক নীতি এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এই সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলবে। অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ ২০২৬ সালের মধ্যে প্রকাশিত হলে এই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত, কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের সরকারি ঘোষণার দিকে নজর রাখতে হবে এবং তাদের আর্থিক পরিকল্পনা সেই অনুযায়ী করতে হবে।