কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে প্রায় ৫০ লক্ষ কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগী। সপ্তম বেতন কমিশনের মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা, এবং নতুন কমিশন ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, কমিশনের গঠন ও শর্তাবলী নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা থাকায় কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। তাঁদের কণ্ঠে একটাই বার্তা: “আমরা আর কত অপেক্ষা করব?” এই প্রবন্ধে আমরা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের আশা, হতাশা এবং প্রত্যাশার গল্প তুলে ধরব।
কর্মচারীদের ক্ষোভ ও প্রত্যাশা
কলকাতার একটি কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরে কর্মরত ৪৫ বছর বয়সী সঞ্জয় মণ্ডল বলেন, “আমরা প্রতি দশ বছরে বেতন কাঠামোর সংশোধনের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গেছে। মহার্ঘ ভাতা (DA) বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। আমরা চাই অষ্টম বেতন কমিশন দ্রুত গঠিত হোক এবং আমাদের বেতন ও ভাতা বাড়ুক।” সঞ্জয়ের মতো লক্ষ লক্ষ কর্মচারী মনে করেন, বর্তমান বেতন কাঠামো তাঁদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে মহার্ঘ ভাতা ৫০% থেকে বেড়ে ৫৫% হয়েছে, এবং ২০২৫ সালের জুলাইয়ে এটি ৬৬% পর্যন্ত উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এই বৃদ্ধি সত্ত্বেও, কর্মচারীরা মনে করেন যে মূল বেতন বাড়ানো এবং মহার্ঘ ভাতা একীভূত করা জরুরি। দিল্লির একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষক রীতা দাস (৫২) বলেন, “আমার মাসিক বেতন ৪৮,০০০ টাকা। কিন্তু কলকাতার মতো শহরে বাড়িভাড়া, শিক্ষা এবং চিকিৎসার খরচ মেটাতে এই টাকা যথেষ্ট নয়। অষ্টম বেতন কমিশন আমাদের জীবনে একটু স্বস্তি আনতে পারে।”
পেনশনভোগীদের দুর্দশা
পেনশনভোগীদের অবস্থা আরও নাজুক। ৬৮ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী অমিতাভ চ্যাটার্জি বলেন, “আমার পেনশন মাসে ২২,০০০ টাকা। চিকিৎসা খরচ এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে আমাকে সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে। অষ্টম বেতন কমিশন যদি পেনশন বাড়ায়, তবে আমরা একটু নিশ্চিন্ত হতে পারি।” অমিতাভের মতো অনেক পেনশনভোগী মনে করেন, সরকারের উচিত পেনশন কাঠামো সংশোধন করে বয়স্ক নাগরিকদের জন্য আরও সুরক্ষা দেওয়া।
কমিশন গঠনের বিলম্ব
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের অনুমোদন দিলেও, এর শর্তাবলী এবং চেয়ারম্যান নিয়োগ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এই বিলম্বে কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। জাতীয় পরামর্শদাতা যন্ত্রপাতি (JCM)-এর সেক্রেটারি শিব গোপাল মিশ্র বলেন, “আমরা সরকারের কাছে বারবার দাবি জানিয়েছি যে কমিশনের কাজ দ্রুত শুরু করা হোক। কিন্তু বাজেটে কোনও আর্থিক বরাদ্দ না থাকায় আমরা আশঙ্কিত।” তিনি আরও বলেন, “কর্মচারীরা তাদের অধিকারের জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন, কিন্তু এই অপেক্ষা আর কতদিন?”
আর্থিক প্রভাব ও সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, অষ্টম বেতন কমিশন বাস্তবায়িত হলে সরকারের উপর প্রায় ১.৫ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক বোঝা পড়তে পারে। তবে, এটি কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে। অর্থনীতিবিদ ড. প্রণব সেন বলেন, “বেতন বৃদ্ধি ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়াবে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। কিন্তু সরকারকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “মহার্ঘ ভাতা একীভূত করা হলে বেতন কাঠামো আরও সরল হবে, তবে এটি সরকারের আর্থিক নীতির ওপর নির্ভর করবে।”
কর্মচারীদের মধ্যে মহার্ঘ ভাতা একীভূতকরণের দাবি জোরালো। দিল্লির একটি সরকারি হাসপাতালের নার্স রুমা সাহা (৩৮) বলেন, “আমরা শুধু বেতন বৃদ্ধি নয়, একটি ন্যায্য কাঠামো চাই। মহার্ঘ ভাতা একীভূত হলে আমাদের বেতন এবং ভবিষ্যৎ পেনশন বাড়বে।” তাঁর মতো অনেকে মনে করেন, এই পদক্ষেপ তাঁদের আর্থিক স্থিতিশীলতা এনে দেবে।
কর্মচারীদের আশা
কর্মচারী ইউনিয়নগুলি মনে করে, অষ্টম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ থেকে ৩.০ এর মধ্যে হতে পারে। এর ফলে সর্বনিম্ন মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫১,৪৮০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া, গৃহভাড়া ভাতা (HRA) এবং পরিবহন ভাতা (TA) সংশোধনের দাবিও রয়েছে। মুম্বইয়ের একটি সরকারি ব্যাঙ্কের কর্মী অরুণ শর্মা বলেন, “আমরা শুধু বেতন নয়, আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য একটি ন্যায্য কাঠামো চাই। সরকারের উচিত আমাদের কথা শোনা।”
সরকারের চ্যালেঞ্জ
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ চূড়ান্ত করতে ১৫ থেকে ১৮ মাস সময় লাগতে পারে। এই বিলম্বে কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। সাম্প্রতিক একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে একজন কর্মচারী লিখেছেন, “আমরা আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ এই কমিশনের ওপর নির্ভর করছে।” এই ধরনের পোস্টগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে, যা কর্মচারীদের ক্ষোভের প্রতিফলন।
অষ্টম বেতন কমিশন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনভোগীদের মধ্যে আশা এবং হতাশা একসঙ্গে কাজ করছে। সঞ্জয়, রীতা এবং অমিতাভের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য এই কমিশনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তবে, কমিশনের গঠন ও বাস্তবায়নে বিলম্ব তাঁদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। সরকার যদি কর্মচারীদের দাবি মেনে নেয়, তবে এটি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত, কর্মচারীদের কণ্ঠে একটাই বার্তা: “আমরা আর কত অপেক্ষা করব?”