আজ থেকে দশ বছর আগেও যেখানে রাস্তার ধারে পানওয়ালার কাছে নগদ টাকা ছাড়া কিছু ভাবা যেত না, আজ সেখানে ‘ভিম’ বা ‘ফোন পে’-র কিউআর কোড স্ক্যান করেই মিলছে সিগারেট কিংবা পান। ভারতবর্ষে ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে এই অসাধারণ পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস বা ইউপিআই (UPI)।
২০১৬ সালের এপ্রিলে ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (NPCI) UPI চালু করেছিল রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (RBI) এবং ইন্ডিয়ান ব্যাংকস অ্যাসোসিয়েশনের (IBA) সহায়তায়। মূল লক্ষ্য ছিল একটি এমন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যা সাধারণ মানুষের জন্য সহজ, দ্রুত ও সুরক্ষিত হবে। আর ঠিক সেটাই ঘটেছে।
বর্তমানে UPI এমন এক ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে মোবাইল ফোন নম্বর বা ভার্চুয়াল পেমেন্ট অ্যাড্রেস (VPA) ব্যবহার করে ব্যাঙ্ক-টু-ব্যাঙ্ক রিয়েল টাইম লেনদেন সম্ভব হচ্ছে। বিল পেমেন্ট থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, বাজার করা, এমনকি ছোট দোকানে কেনাকাটা—সবেতেই UPI এখন অপরিহার্য।
অভূতপূর্ব বৃদ্ধির পরিসংখ্যান
ন্যাশনাল মিডিয়াগুলির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডিজিটাল লেনদেনের মধ্যে UPI-এর অংশগ্রহণ ৮৩.৭ শতাংশ—যেখানে ২০১৯ সালে এই হার ছিল মাত্র ৩৪ শতাংশ। ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে ভারতে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩৭৫ কোটি, যা ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১৭,০০০ কোটিতে। অর্থমূল্যে এই বৃদ্ধি আরও চমকপ্রদ—৫.৮৬ লাখ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪৬.৮৩ লাখ কোটি টাকা। স্টেটসম্যান জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বছরে ৩৪.৮ শতাংশ হারে ডিজিটাল লেনদেন বেড়েছে—যার প্রধান চালক UPI।
যুব প্রজন্মের নির্ভরতা ও স্মার্টফোনের ভূমিকা
মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিস্টিক্স অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন (MoSPI) পরিচালিত একটি সমীক্ষা বলছে, দেশের ৮৫.৫ শতাংশ পরিবারে অন্তত একটি স্মার্টফোন রয়েছে, আর ১৫-৩৫ বছর বয়সী ৯৯.৫ শতাংশ যুবক ইউপিআই ব্যবহার করেন। এটি দেখায় যে ইউপিআই শুধুই শহরকেন্দ্রিক প্রযুক্তি নয়, বরং দেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে।
সরকারের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য
এই অভূতপূর্ব সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ঘোষণা করেছেন যে আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে দৈনিক ১ বিলিয়ন ইউপিআই লেনদেন করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এটি শুধু প্রযুক্তিগত দিক থেকে নয়, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির (financial inclusion) দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ই-কমার্সে ইউপিআই-এর প্রভাব
UPI-এর সহজলভ্যতা ও গতিশীলতা ই-কমার্স খাতেও বিপ্লব এনেছে। ওয়ালমার্ট ইন্টারন্যাশনালের সিইও ক্যাথরিন ম্যাকলে জানিয়েছেন, ভারতের ই-কমার্সে ‘কুইক কমার্স’ এখন ২০ শতাংশ দখল করেছে এবং প্রতি বছর ৫০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ফ্লিপকার্ট, যেটি ওয়ালমার্ট দ্বারা সমর্থিত, এই সম্প্রসারণের কেন্দ্রে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে UPI
ভারতের এই প্রযুক্তি আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে সিঙ্গাপুর, নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরিশাস, ফ্রান্স, ভুটান ও শ্রীলঙ্কায় ইউপিআই চালু হয়েছে। এর ফলে প্রবাসী ভারতীয়রা খুব সহজেই টাকা পাঠাতে পারছেন দেশে, যা রেমিটেন্স খাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ভারতের ডিজিটাল লেনদেন বিপ্লব, বিশেষত UPI-এর মাধ্যমে, শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক পরিবর্তনেরও প্রতীক হয়ে উঠেছে। সঠিক প্রযুক্তি, সরকারি নীতির সহায়তা, এবং বেসরকারি খাতের উদ্ভাবনী শক্তির সম্মিলনে গড়ে ওঠা এই পেমেন্ট ইকোসিস্টেম আজ বিশ্বের কাছে এক অনন্য মডেল।
যেখানে এক সময় ব্যাঙ্কের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হত, আজ সেখানে শুধু এক ক্লিকেই সব লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে। আর এই প্রযুক্তিগত ও নীতিগত বিজয় ভারতের ডিজিটাল ভবিষ্যতের উজ্জ্বল দিশা দেখাচ্ছে।