২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ৭ম বেতন কমিশনের বাস্তবায়ন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য নতুন আশা জাগিয়েছিল। সরকারের দাবি ছিল, এই কমিশন কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনবে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক পরিবারের জন্য ভিন্ন। বেতন বৃদ্ধি সত্ত্বেও, মুদ্রাস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং অপর্যাপ্ত ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের কারণে অনেক পরিবার আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, অষ্টম বেতন কমিশনের (8th Pay Commission) ঘোষণা (২০২৫ সালের জানুয়ারি) নতুন সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এটি কি সত্যিই সাধারণ কর্মচারীদের জন্য পরিবর্তন আনবে?
৭ম বেতন কমিশন: প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা
৭ৈ বেতন কমিশন ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়, যা মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা এবং ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৫৭ নির্ধারণ করে। এই কমিশনের আওতায় মূল বেতন ৬ষ্ঠ বেতন কমিশনের ৭,০ৰৰ থেকে বেড়ে ১৮,০ৰৰ হয়, এবং পেনশন ৩,৫০ৰ থেকে বেড়ে ৯,০ৰৰ হয়। সরকার দাবি করেছিল যে এই বৃদ্ধি কর্মচারীদের আর্থিক সুরক্ষা দেবে। কিন্তু বাস্তবে, অনেক পরিবারের জন্য এই বেতন বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়েছে।
কলকাতার একজন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী, রমেশ দাস (ছদ্মনাম), তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, “৭ম বেতন কমিশনের পর আমার মূল বেতন বেড়েছিল, কিন্তু স্কুল ফি, বাড়ি ভাড়া, ওষুধের খরচ—সবকিছুর দাম এত বেড়েছে যে বেতনের বাড়তি টাকা কোথাও যায় না।” তিনি আরও বলেন, “আমার দুই সন্তানের শিক্ষার খরচ এবং বাবা-মায়ের চিকিৎসার জন্য সঞ্চয় করা প্রায় অসম্ভব।” রমেশের মতো অনেক কর্মচারী মনে করেন যে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৫৭-এর পরিবর্তে ৩.৬৮ হলে তাঁদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো হতো।
অন্যদিকে, পেনশনভোগীদের অবস্থাও তেমন সুখকর নয়। দিল্লির একজন অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মচারী, শান্তি দেবী (ছদ্মনাম), বলেন, “পেনশন বেড়ে ৯,০ৰৰ হয়েছে, কিন্তু ওষুধের দাম এবং দৈনন্দিন খরচের তুলনায় এটা যথেষ্ট নয়। আমি একা থাকি, তাই পরিবারের সাহায্য ছাড়া চলা কঠিন।” এই ধরনের গল্প দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে, যা ৭ম বেতন কমিশনের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে।
মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়: প্রধান চ্যালেঞ্জ
২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং বাসস্থানের খরচ সাধারণ পরিবারের বাজেটের বড় অংশ গ্রাস করছে। ৭ম বেতন কমিশনের অধীনে মহার্ঘ ভাতা (DA) বর্তমানে ৫৩% (জুলাই ২০২৪ থেকে), যা ২০২৬ সালের জানুয়ারি নাগাদ ৭০% হতে পারে। তবুও, এই ভাতা বেতনের সঙ্গে মিলিয়ে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটাতে অপর্যাপ্ত।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ৭ম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর এবং বেতন বৃদ্ধি (২৩-২৫%) মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। ফলে, নিম্ন ও মধ্যম স্তরের কর্মচারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতি পরিবারগুলির সঞ্চয় ক্ষমতা কমিয়েছে এবং ঋণের উপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে।
৮ম বেতন কমিশন: নতুন আশার আলো?
২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ৮ম বেতন কমিশন গঠনের অনুমোদন দেয়। এই কমিশন ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কর্মচারী ইউনিয়নগুলি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ থেকে ৩.৫-এর মধ্যে নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে, যা মূল বেতন ১৮,০ৰৰ থেকে বাড়িয়ে ৪১,ৰৰৰ-৫১,৪৮ৰৰ এবং পেনশন ৯,ৰৰৰ থেকে ২০,৫ৰৰ-২৫,৭৪ৰৰ করতে পারে।
এই বেতন বৃদ্ধি (২৫-৩৫%) এবং ভাতা সংশোধন কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। উদাহরণস্বরূপ, বাড়ি ভাড়া ভাতা (HRA), যা বর্তমানে মূল বেতনের ৮-২৪% (শহরভেদে), তা বাড়তে পারে। এছাড়া, পেনশন বৃদ্ধি অবসরপ্রাপ্তদের আর্থিক সুরক্ষা দেবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি এক্স-এ বলেছেন, “৮ম বেতন কমিশন জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং ভোগ বাড়াবে।”
কিন্তু, কিছু কর্মচারী এখনও সন্দিহান। মুম্বাইয়ের একজন অফিসার, অজয় শর্মা (ছদ্মনাম), বলেন, “৮ম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর যদি আবার কম হয়, তবে আমাদের অবস্থা বদলাবে না। মুদ্রাস্ফীতি এবং শিক্ষা-চিকিৎসার খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেতন বাড়ানো দরকার।”
অর্থনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
৮ম বেতন কমিশন প্রায় ৪৮.৬২ লক্ষ কর্মচারী এবং ৬৭.৮৫ লক্ষ পেনশনভোগীকে প্রভাবিত করবে। বেতন বৃদ্ধি ভোগ বাড়িয়ে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আনতে পারে। তবে, সরকারকে এই বৃদ্ধির জন্য প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হবে, যা বাজেটের ভারসাম্য রক্ষায় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
কর্মচারী ইউনিয়নগুলি, যেমন ন্যাশনাল কাউন্সিল-জয়েন্ট কনসালটেটিভ মেশিনারি (NC-JCM), ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, ন্যূনতম বেতন, এবং ভাতার জন্য একটি “কমন মেমোরেন্ডাম” তৈরি করছে। এই দাবিগুলি সরকারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তি হবে।
৭ম বেতন কমিশন অনেক পরিবারের জন্য প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় বেতন ও পেনশন বৃদ্ধি অপর্যাপ্ত ছিল। ৮ম বেতন কমিশনের ঘোষণা নতুন আশা জাগিয়েছে, কিন্তু এর সাফল্য নির্ভর করবে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, ভাতা সংশোধন, এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর। কর্মচারী ও পেনশনভোগীরা এখন অপেক্ষায় আছেন সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য, যা তাঁদের জীবনে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারে।