আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের হুমকির মাঝেও ভারত তার রফতানি খাতে (India export record) একটি অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক বছর ২০২৪-২৫-এ ভারতের মোট রফতানির মান $৮২৪.৯ বিলিয়ন পৌঁছেছে, যা এটিকে সকল কালের সর্বোচ্চ রেকর্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই অঙ্কটি গত বছরের $৭৭৮.১ বিলিয়ন থেকে ৬.০১% বৃদ্ধি নির্দেশ করে, যা ভারতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও বিশ্ববাজারে তার স্থানের একটি প্রমাণ। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (RBI) এবং বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য এই সাফল্যের পেছনে ভারতের বৈচিত্র্যময় রফতানি বৌদ্ধিকতা ও সরকারি নীতিগত পদক্ষেপের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপট
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন আমেরিকা ভারতীয় পণ্যদ্রব্যে ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যা ভারতীয় রপি মুদ্রার মূল্যহ্রাস এবং শেয়ারবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। গত শুক্রবার রপি ডলারের বিরুদ্ধে ৪০ পয়সা বৃদ্ধি পেয়ে ৮৭.২৫-এ পৌঁছেছে, যা তৈলদ্রব্যের দাম কমে যাওয়া এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হস্তক্ষেপের ফলে সম্ভব হয়েছে। তবে, এই শুল্ক আরোপের হুমকি সত্ত্বেও ভারত তার রফতানি বৈচিত্র্য বাড়িয়ে বিশ্ববাজারে নতুন পথ খুঁজে বের করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সাফল্যের পেছনে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ অভিযানের মাধ্যমে গৃহীত সক্রিয় পদক্ষেপগুলো কার্যকর হয়েছে।
রফতানির বৈচিত্র্য ও সেক্টরাল অবদান
ভারতের রফতানি বৃদ্ধির পেছনে সেবা খাত (services sector) এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (MSMEs) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তথ্যপ্রযুক্তি, ফিনটেক, পর্যটন এবং টেলিকম সেক্টরে ১৩.৬% বৃদ্ধি রেকর্ড করা হয়েছে, যা রফতানির একটি বড় অংশ নিজের করে নিচ্ছে। অন্যদিকে, টেক্সটাইল, প্রকৌশল পণ্য এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যে MSMEs-এর অবদান ৪০% এর বেশি, যা ভারতীয় অর্থনীতির পিছনের শক্তিমান চালিকা শক্তি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সরকারের প্রযুক্তি উন্নয়ন প্রণোদনা (PLI) এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা এই সেক্টরগুলোর বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক স্থান নিশ্চিত করেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন পথ
আমেরিকার শুল্ক আরোপের কারণে ভারত তার রফতানির নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) এবং মধ্যপ্রাচ্যের উপর জোর দিয়েছে। বর্তমানে EU-এর সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য $১২০ বিলিয়ন-এ পৌঁছেছে, এবং ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ করিডর (IMEC) বন্দরের মাধ্যমে শিপিং সময় ৪০% কমে গেছে। এই করিডরটি ভারতকে আফ্রিকা ও ইউরোপে দ্রুত বাজার প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। গত বছরের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যে রফতানি ২৫% বেড়েছে, যা ভারতের ভৌগোলিক সুবিধা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ফল।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সময় ভারতের অর্থনীতি কৃষি-নির্ভর ছিল এবং রফতানি খাত প্রায় নিশ্চিহ্ন ছিল। উপনিবেশিক নীতির ফলে হস্তশিল্প ও হস্তশিল্প খাত ধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। তবে, স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক সংস্কার, সড়ক নেটওয়ার্কে ৫৯% বৃদ্ধি (২০১৪ থেকে), এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে ভারত আজ বিশ্বে একটি শক্তিশালী রফতানি জাতি হিসেবে উদয় হয়েছে।
তবে, ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জও কম নয়। MSMEs-এর ডিজিটালায়েশন, সস্তা ক্রেডিট সুযোগ, এবং নিয়ন্ত্রণ সরলীকরণ প্রয়োজন, যা রফতানির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। এছাড়া, রপির মূল্যহ্রাস ও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা ভারতের জন্য একটি বড় পরীক্ষা হবে। তবে, বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করছেন যে, সরকার যদি এই খাতে আরও বিনিয়োগ করে এবং নীতি সংস্কার চালিয়ে যায়, তবে ভারত আগামী দশকে $১ ট্রিলিয়ন রফতানির লক্ষ্য অর্জন করতে পারে।
ভারতের এই রফতানি সাফল্য ট্রাম্পের শুল্ক-শাস্তির মতো বাধা অতিক্রম করে একটি নতুন আত্মবিশ্বাসের সঙ্কেত দেয়। এটি শুধু অর্থনৈতিক প্রগতির প্রমাণ নয়, বরং ভারতীয় শিল্পক্ষেত্রের সৃজনশীলতা ও সংকটপ্রবণতার পরিচয়। ভবিষ্যৎ রফতানি বৃদ্ধির জন্য সরকার ও ব্যবসায়ীদের যৌথ প্রচেষ্টা এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ভারত বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে আরও শক্তভাবে অবস্থান করে।