অষ্টম বেতন কমিশন বনাম মুদ্রাস্ফীতি! এটি কি সত্যিই ব্যবধান পূরণ করতে পারবে?

কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) একটি বহু প্রতীক্ষিত ঘোষণা। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত এই কমিশন ২০২৬ সালের ১…

8th Pay Commission: Can Salary Hikes Bridge Inflation Gap for Employees?

কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) একটি বহু প্রতীক্ষিত ঘোষণা। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত এই কমিশন ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এই কমিশনের মূল উদ্দেশ্য হলো কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশনের কাঠামো পর্যালোচনা করে মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তা পুনর্গঠন করা। তবে, প্রশ্ন উঠছে— এই বেতন কমিশন কি সত্যিই মুদ্রাস্ফীতির কারণে সৃষ্ট আর্থিক ব্যবধান পূরণ করতে সক্ষম হবে?

অষ্টম বেতন কমিশন: প্রত্যাশা ও সম্ভাবনা

   

অষ্টম বেতন কমিশনের ঘোষণা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় ৫০ লক্ষ কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। গত দশক ধরে মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। খাদ্য, জ্বালানি, শিক্ষা, এবং চিকিৎসার খরচ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এই কমিশনের মাধ্যমে বেতন বৃদ্ধি এবং ভাতার সংশোধনের মাধ্যমে এই ব্যবধান পূরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেতন বৃদ্ধির হার ২০% থেকে ৩৫% পর্যন্ত হতে পারে, এবং ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর (বেতন গণনার গুণক) ২.২৮ থেকে ২.৮৬ এর মধ্যে থাকতে পারে। এর ফলে ন্যূনতম মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪১,০০০ থেকে ৫১,৪৮০ টাকা হতে পারে।

মুদ্রাস্ফীতির চ্যালেঞ্জ
ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গত আট বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির কারণে গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন গম, চাল, রান্নার তেল এবং সবজির দাম বেড়েছে। এছাড়া, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং রিয়েল এস্টেটের খরচও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সপ্তম বেতন কমিশনের সময় ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ২.৫৭, যা ২০১৬ সালে ন্যূনতম বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮,০০০ টাকা করেছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দশ বছরের ব্যবধানে মুদ্রাস্ফীতির হার এতটাই বেড়েছে যে, এই বেতন বৃদ্ধি আর পর্যাপ্ত নয়। একজন অর্থনীতিবিদের মতে, অষ্টম বেতন কমিশনের চ্যালেঞ্জ শুধু বেতন বাড়ানো নয়, বরং দ্রুত বর্ধমান শহুরে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ-নিরাপদ বেতন কাঠামো তৈরি করা।

ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর এবং বেতন বৃদ্ধি
অষ্টম বেতন কমিশনের বেতন বৃদ্ধির মূল নির্ধারক হলো ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর। এটি বর্তমান মূল বেতনের সঙ্গে গুণ করে নতুন বেতন নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হয়, তাহলে ১৮,০০০ টাকার মূল বেতন বেড়ে হবে ৫১,৪৮০ টাকা। এছাড়া, মহার্ঘ ভাতা (DA), গৃহভাড়া ভাতা (HRA) এবং ভ্রমণ ভাতা (TA) নতুন মূল বেতনের ভিত্তিতে পুনর্গণনা করা হবে। তবে, কিছু সূত্রের মতে, ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৯২ হলে বেতন বৃদ্ধি মাত্র ২৪% হবে, যা মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় কম হতে পারে। এই বৈষম্যের কারণে কর্মচারী ইউনিয়নগুলো ৩.৬৮ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের দাবি জানিয়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে আরও ভালোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

পেনশনভোগীদের জন্য প্রভাব
অষ্টম বেতন কমিশন শুধু কর্মচারীদের জন্য নয়, পেনশনভোগীদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ন্যূনতম পেনশন ৯,০০০ টাকা, যা অষ্টম কমিশনের পর ৩০% পর্যন্ত বাড়তে পারে। ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হলে পেনশন বেড়ে প্রায় ২৫,৭৪০ টাকা হতে পারে। এটি পেনশনভোগীদের জন্য আর্থিক সুরক্ষা বাড়াবে, বিশেষ করে যখন চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার খরচ ক্রমাগত বাড়ছে।

Advertisements

অর্থনৈতিক প্রভাব
বেতন বৃদ্ধির ফলে কর্মচারীদের হাতে নিষ্পত্তিযোগ্য আয় বাড়বে, যা ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে। তবে, এই বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতিকেও ত্বরান্বিত করতে পারে, কারণ বাজারে অতিরিক্ত অর্থ প্রবাহ বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকে এই বৃদ্ধির সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এছাড়া, রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রীয় বেতন কমিশনের সুপারিশ গ্রহণে বিলম্ব করতে পারে, যা রাজ্য কর্মচারীদের জন্য অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে।

সমালোচনা ও উদ্বেগ
অষ্টম বেতন কমিশনের সম্ভাব্য বিলম্ব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। যদিও ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কমিশনের গঠন অনুমোদিত হয়েছে, এখনও চেয়ারম্যান বা সদস্যদের নিয়োগ হয়নি। এই বিলম্বের ফলে বেতন সংশোধন ২০২৭ পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারে। এছাড়া, দশ বছরের ব্যবধানে বেতন সংশোধন মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না বলে সমালোচনা রয়েছে। মহার্ঘ ভাতা (DA) বর্তমানে ৫৩% এবং ২০২৬ সালে ৭০% হতে পারে, কিন্তু এটি পুনরায় শূন্যে রিসেট হবে, যা কর্মচারীদের হাতে নেট বেতন কমাতে পারে।

সমাধানের পথ
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে আরও গতিশীলভাবে মোকাবিলা করতে বেতন কমিশনের সময়কাল কমানো উচিত। ত্রৈমাসিক বা অর্ধ-বার্ষিক মহার্ঘ ভাতা সংশোধন এবং পারফরম্যান্স-ভিত্তিক বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবও আলোচনায় রয়েছে। এছাড়া, শহর ও গ্রামীণ এলাকার জীবনযাত্রার খরচের পার্থক্য অনুযায়ী ভাতা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

অষ্টম বেতন কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য আর্থিক স্বস্তি আনতে পারে। তবে, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্য রাখতে এটি কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, ভাতা সংশোধন এবং বাস্তবায়নের সময়সীমার উপর। সরকারের উচিত এই কমিশনের মাধ্যমে শুধু বেতন বৃদ্ধি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। কর্মচারী ও পেনশনভোগীরা এখন অপেক্ষায় রয়েছেন, এই কমিশন তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কিনা, তা দেখার জন্য।