ছোটোবেলায় ইতিহাস বইতে বাংলার ইতিহাস আমরা সকলেই পড়েছি। কিন্তু, বাংলার ইতিহাসের কথা বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে মুর্শিদাবাদের নাম। হ্যাঁ, সেই মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা পর্যন্ত বাংলার নবাবদের স্মৃতি যেখানে জড়িয়ে আছে, সেই মুর্শিদাবাদ। যেখানে নবাবি যুগের সাক্ষ্যবহনকারী হাজারদুয়ারিতে (Hazarduari) ইতিহাস আজও জীবন্ত। অথচ হাজারদুয়ারির প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন জার সমাধি আজ বড় অবহেলায়, অযত্নে মলিন। কেন ? জানব সেকারণই।
১৮২৯ সালের ২৯ অগাস্ট মুর্শিদাবাদে নবাবের শহর লালবাগে হাজারদুয়ারি প্যালেস মিউজ়িয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর থেকে স্বদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে হুমায়ুন জার সাধের “কুঠিবাড়ি”। পরতে পরতে ইতিহাসে মোড়া হাজারদুয়ারি সেই জন্মলগ্ন থেকেই দেশবিদেশের লাখ লাখ পর্যটককে আপন গরিমায় টেনে এনেছে। সামনের বিশাল খোলা মাঠ থেকে ইতিহাসের অমর সাক্ষ্য দেখে কেউ নবাবি আমলে হারিয়ে গেছেন। কেউ বা বিহ্বল হয়ে দেখেও মনের আশ মেটাতে পারছেন না। ইতিহাসপ্রেমী থেকে শুরু করে ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয়হীন মানুষও মাথা নত করে যে স্থাপত্যকে কুর্নিশ জানিয়েছে। অথচ অনেকেই ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনে হাজারদুয়ারির প্রতিষ্ঠাতা, জনককে একবারও ধন্যবাদ জানিয়ে যাননি। আজ তাই হাজারদুয়ারির প্রতিষ্ঠতা তথা অষ্টম নবাব হুমায়ুন জার সমাধি, শহরের একপ্রান্তে অবহেলায় হতযত্নে পড়ে রয়েছে। বেগম শাহ খানমের প্রিয় এই উদ্যানে শুয়ে রয়েছেন মিরজ়াফরের পিতা মহম্মদ নাজ়িফ, মিরজ়াফরের তিন বেগম শাহ খানম, মুন্নি বেগম ও বুব্বি বেগম।
১৮০২ সালের ১ ডিসেম্বর সপ্তম নবাব ওয়ালা জা নিজামত ডিপোজিট ফান্ডের টাকায় একটি কলেজ ও একটি প্যালেস নির্মাণে প্রস্তাব দেন। তাঁর পরিকল্পনা ও বাজেট জমা দিতে অনেকটা সময় চলে যায়। ওয়ালা জার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হুমায়ুন জা ৪১ একর জায়গা জুড়ে হাজারদুয়ারি প্যালেস নির্মাণের কাজ শুরু করেন। প্যালেসটি দৈর্ঘ্যে ৪২৫ ফুট ও প্রস্থে ২০০ ফুট। প্যালেসের স্থাপত্যের শিল্পকলা গ্রিসিয়াস ডোরিক। নির্মাণ খরচ পড়েছিল সাড়ে ষোলো লাখ টাকা বা ১ লাখ ৬৭০০০ পাউন্ড। হুমায়ুন জা নাম দিয়েছিলেন “বড়কুঠি”। আসল নকল মিলিয়ে হাজারটা দরজা রয়েছে এর। তাই নাম হাজারদুয়ারি।
মীরজ়াফরের স্ত্রী মুন্নি বেগমের মৃত্যুর পর থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জাফরাগঞ্জ সমাধি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিজামত ডিপোজিট ফান্ড থেকে মাসিক ৯,৬০০ টাকা বরাদ্দ করেছিল। মালি, গার্ড, মুনসি থেকে শুরু করে নিয়মিত কোরান পাঠের জন্য সরকারি খরচে লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। নবাবি তক্ত যত পুরনো হয়েছে নিজামত ফান্ড থেকে বরাদ্দের পরিমাণ ততই কমতে শুরু করে। ফলে নবাব পরিবারের সমাধি রক্ষণাবেক্ষণের হাল খারাপ হতে শুরু করে।
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সমাধি সংস্কারের জন্য দরবারও করা হয়েছে বলে জানালেন নবাব পরিবারের এক সদস্য। নবাব পরিবারের বর্তমান সদস্য তথা সরকারি স্কুলের উর্দু শিক্ষক সৈয়দ আসিফ আলি মির্জ়া বলেন, “আমি নিজে একজন ইতিহাস গবেষক। তাই বহু তথ্য ঘেঁটে ফলক হারানো সমাধির নীচে কোন নবাব নাজ়িম শুয়ে রয়েছেন, তা বের করেছি। কিন্তু, আমার মনে হয়, সরকার ছাড়া জাফরাগঞ্জ কবরখানার সংস্কার সম্ভব নয়।”