ভারতীয় পুরাণে নারী দেবীরা শক্তি (Shakti Goddesses), সৃষ্টি, ধ্বংস এবং পুষ্টির প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়ে আসছেন। হিন্দু ধর্মে শক্তি দেবী বা নারী দেবত্ব শক্তির প্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হয়, যারা জীবনের বিভিন্ন দিকে প্রভাব বিস্তার করেন। এই দেবীরা কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতিনিধিত্বই করেন না, বরং নারী শক্তি, সাহস এবং সৃজনশীলতার প্রতীক হিসেবেও সম্মানিত। ২০২৫ সালে, যখন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, তখন এই শক্তিশালী নারী দেবীদের গুরুত্ব আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা ভারতীয় পুরাণের শীর্ষ ১০ শক্তিশালী নারী দেবীর তালিকা তুলে ধরব, যাঁরা শক্তি ও ঐশ্বরিকতার প্রতীক।
১. দেবী দুর্গা (Durga)
দেবী দুর্গা হলেন শক্তি দেবীর প্রধান রূপ এবং হিন্দু পুরাণের অন্যতম শক্তিশালী দেবী। তিনি মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে অশুভ শক্তির বিনাশকারী হিসেবে পরিচিত। দশভুজা দুর্গা শক্তি, সাহস এবং সুরক্ষার প্রতীক। নবরাত্রি উৎসবে তাঁকে পূজা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে দুর্গা পূজা সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে পালিত হয়।
২. দেবী কালী (Kali)
কালী হলেন শক্তির মূর্তি এবং ধ্বংসের দেবী। তিনি অশুভ শক্তির বিনাশকারী এবং সময়ের প্রতীক। তাঁর ভয়ঙ্কর রূপ সত্ত্বেও, তিনি মাতৃরূপে ভক্তদের রক্ষা করেন। পশ্চিমবঙ্গে কালীপূজা দীপাবলির সময় উদযাপিত হয়। তাঁর কালো রূপ এবং ত্রিশূল নিয়ে দাঁড়ানো ভঙ্গিমা শক্তি ও রহস্যের প্রতীক।
৩. দেবী লক্ষ্মী (Lakshmi)
লক্ষ্মী হলেন সম্পদ, সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের দেবী। তিনি বিষ্ণুর সঙ্গিনী এবং দীপাবলি উৎসবে বিশেষভাবে পূজিত হন। লক্ষ্মীকে চার ভুজাযুক্ত এবং পদ্মে বসে থাকা অবস্থায় দেখা যায়। তিনি কেবল আর্থিক সমৃদ্ধি নয়, আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধিরও প্রতীক।
৪. দেবী সরস্বতী (Saraswati)
সরস্বতী হলেন জ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্প এবং শিক্ষার দেবী। তিনি বিষ্ণু-লক্ষ্মীর সঙ্গে ত্রিদেবীর একজন। বসন্ত পঞ্চমীতে তাঁকে পূজা করা হয়। তাঁর শুভ্র বেশ এবং বীণা হাতে থাকা রূপ জ্ঞান ও সৃজনশীলতার প্রতীক। পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকরা তাঁকে বিশেষভাবে পূজা করেন।
৫. দেবী পার্বতী (Parvati)
পার্বতী হলেন শিবের সঙ্গিনী এবং প্রেম, উর্বরতা ও ভক্তির দেবী। তিনি দুর্গা ও কালীর মৃদু রূপ হিসেবে পরিচিত। পার্বতী তপস্যার মাধ্যমে শিবের মন জয় করেছিলেন, যা তাঁর অধ্যবসায়ের প্রতীক। তিনি গৌরী নামেও পূজিত হন এবং হরগৌরী পূজা পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়।
৬. দেবী সীতা (Sita)
সীতা হলেন রামায়ণের কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং ধৈর্য, পবিত্রতা ও ভক্তির প্রতীক। তিনি বিষ্ণুর অবতার রামের স্ত্রী। সীতার জীবন থেকে নারী শক্তি এবং ত্যাগের শিক্ষা পাওয়া যায়। তিনি ভারতীয় পুরাণে নারীত্ব ও সহনশীলতার আদর্শ রূপ হিসেবে বিবেচিত হন।
৭. দেবী দ্রৌপদী (Draupadi)
মহাভারতের দ্রৌপদী হলেন সাহস, ন্যায়বিচার এবং শক্তির প্রতীক। পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী হিসেবে তিনি তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং দৃঢ়তার জন্য পরিচিত। দ্রৌপদীর জীবন নারী শক্তির এক অনন্য উদাহরণ। তিনি দক্ষিণ ভারতে বিশেষভাবে পূজিত হন।
৮. দেবী চণ্ডী (Chandi)
চণ্ডী হলেন দুর্গার একটি ভয়ঙ্কর রূপ, যিনি চণ্ডীকা নামেও পরিচিত। তিনি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী। চণ্ডী পাঠ এবং নবরাত্রি উৎসবে তাঁকে পূজা করা হয়। তাঁর শক্তিশালী রূপ কৃষ্ণশক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।
৯. দেবী অন্নপূর্ণা (Annapurna)
অন্নপূর্ণা হলেন খাদ্য ও পুষ্টির দেবী। তিনি শিবের সঙ্গিনী এবং সংসারে খাদ্য সরবরাহের প্রতীক। বারাণসীতে অন্নপূর্ণা মন্দিরে তাঁকে বিশেষভাবে পূজা করা হয়। তিনি দানশীলতা ও মাতৃত্বের প্রতীক।
১০. দেবী রাধা (Radha)
রাধা হলেন কৃষ্ণের প্রিয়া এবং ভক্তি ও প্রেমের প্রতীক। তিনি ভাগবত পুরাণে বিশেষভাবে উল্লিখিত। রাধার প্রেম কৃষ্ণের প্রতি আধ্যাত্মিক ভক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। রাধাষ্টমী উৎসবে তাঁকে পূজা করা হয়।
কেন এই দেবীরা শক্তিশালী?
এই দেবীরা শুধুমাত্র ধর্মীয় প্রতীক নয়, বরং নারী শক্তির বিভিন্ন রূপের প্রতিনিধিত্ব করেন। দুর্গা ও কালী যেমন ধ্বংস ও সুরক্ষার প্রতীক, তেমনি লক্ষ্মী ও সরস্বতী সমৃদ্ধি ও জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করেন। পার্বতী ও সীতা নারীত্ব, ধৈর্য এবং প্রেমের আদর্শ। এই দেবীরা ভারতীয় সমাজে নারীর গুরুত্ব ও শক্তি তুলে ধরে।
পশ্চিমবঙ্গে নারী দেবীদের তাৎপর্য
পশ্চিমবঙ্গে শক্তি দেবীর পূজা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। দুর্গা পূজা, কালী পূজা এবং সরস্বতী পূজা রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এই উৎসবগুলি কেবল ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক একত্রতার প্রতীক। ২০২৫ সালে, এই উৎসবগুলি পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে উদযাপিত হচ্ছে, যা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন দেখায়।
ভারতীয় পুরাণের শক্তিশালী নারী দেবীরা কেবল ধর্মীয় প্রতীক নয়, বরং নারী শক্তি, সৃজনশীলতা এবং সাহসের প্রতিনিধিত্ব করে। দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং অন্যান্য দেবীরা ভারতীয় সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ২০২৫ সালে, যখন ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, এই দেবীদের গুরুত্ব আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। এই দেবীদের পূজা এবং তাঁদের গল্প আমাদের শক্তি, জ্ঞান এবং ভক্তির পথে অনুপ্রাণিত করে।৫