অফিস টাইমে ট্রাফিক জ্যামে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে কলকাতা

বস্টন কন্সালটিং গ্রুপ (BCG) এবং উবেরের সম্মিলিত একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, অফিসের ট্রাফিক পিক আওয়ারে কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় নষ্টের শহর (Kolkata…

Kolkata Tops Global Office-Hour Traffic Jam

বস্টন কন্সালটিং গ্রুপ (BCG) এবং উবেরের সম্মিলিত একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, অফিসের ট্রাফিক পিক আওয়ারে কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় নষ্টের শহর (Kolkata traffic jam) হিসেবে শীর্ষে রয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, কলকাতায় পীক আওয়ারে ভ্রমণের জন্য সাধারণ সময়ের তুলনায় ১৭১% অতিরিক্ত সময় লাগে, যা এই শহরের গাড়ি ভরা রাস্তা এবং অপর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থার একটি পরিষ্কার প্রতিফলন। এই তালিকায় বাংলোর (১৬২%) এবং মুম্বই (১৩৫%) এর মতো ভারতীয় মেট্রো শহরগুলোও উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে রয়েছে, তবে কলকাতার অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। তুলনামূলকভাবে, হংকং (৬৩%) এবং সিঙ্গাপুর (৫৭%) এর মতো শহরগুলোতে এই সমস্যা অনেক কম, যেখানে উন্নত পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন এবং শহর পরিকল্পনা জ্যাম কমাতে সাহায্য করে।

কলকাতার ট্রাফিক জ্যামের কারণ
কলকাতার রাস্তাগুলো দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত চাপের মুখোমুখি। শহরের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া এবং ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ার ফলে রাস্তার সীমিত স্থান এখন পর্যাপ্ত নয়। গবেষকরা বলছেন, এই শহরে সার্বজনীন পরিবহন ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত হয়নি, যা লোকদের ব্যক্তিগত গাড়ি বা দুইপেয়ালা যানের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে। এছাড়া, রাস্তার জটিলতা, অপর্যাপ্ত সড়ক প্রস্থিরতা এবং প্রায়ই ঘটে যাওয়া নির্মাণ কাজগুলো ট্রাফিক জ্যামকে আরও জটিল করে তুলেছে। একজন স্থানীয় বাসিন্দা, অঙ্কিত চক্রবর্তী, বলেন, “গতকাল আমি মাত্র ৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে ১.৫ ঘণ্টা সময় লাগিয়েছি। এটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে।”

   

তথ্যাধার্য বিশ্লেষণ
BCG-এর এই গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, কলকাতার পীক আওয়ারে গাড়ির গড় গতি মাত্র ৯-১০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা, যা ভারতের অন্যান্য শহরগুলোর তুলনাতেও কম। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লিতে এই গতি ১৩-১৪ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা, মুম্বইয়ে ১১-১২ কিলোমিটার এবং বাংলোরে ১০-১১ কিলোমিটার। এই ধীর গতি শুধুমাত্র সময় নষ্ট করেই থেমে নেই, বরং এটি বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে যানজটের কারণে, কারণ কাজের জন্য দেরি হওয়া এবং জ্বালানি খরচ বাড়ছে।

শহর পরিকল্পনার অভাব
কলকাতা মাস্টার প্ল্যান ২০২৫-এ শহরের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রাস্তা প্রসারণ এবং মেট্রো নেটওয়ার্কের বিস্তার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে, এই পরিকল্পনাগুলো এখনো সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। শহরের প্রাচীন ইমারতগুলো এবং ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো রক্ষা করার চাপ এবং জনসংখ্যার চাপের কারণে নতুন রাস্তা নির্মাণ বা পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এর ফলে শহরের যানজটের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।

Advertisements

সমাধানের পথ
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে, কলকাতায় মেট্রো রেল এবং বাস পরিষেবাকে আরও কার্যকর করা দরকার। উবেরের মতো রাইড-শেয়ারিং সার্ভিসগুলো যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে এটি জ্যাম কমাতে সাহায্য করতে পারে, যেমনটি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ৯১% কনজেস্টন হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া, স্মার্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং কারপুলিং উৎসাহিত করা যেতে পারে। তবে, এই উদ্যোগগুলোর জন্য সরকারি সমর্থন এবং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, যা এখনো পর্যাপ্ত নয়।

সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব
ট্রাফিক জ্যাম শুধুমাত্র ভ্রমণের সময় নষ্ট করছে না, বরং এটি শহরবাসীদের জীবনযাত্রা ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘ সময় যানজটে আটকা থাকা শ্রমিকদের কাজের দক্ষতা কমে যাচ্ছে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক সুরক্ষা কভারেজ ৬৪% পর্যন্ত বেড়েছে (ILO, ২০২৫), কিন্তু শহরী পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে এই পদক্ষেপগুলোর প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়।

কলকাতার ট্রাফিক জ্যামের সমস্যা একটি জটিল চ্যালেঞ্জ, যার সমাধানের জন্য শুধুমাত্র সরকারের উদ্যোগ নয়, নাগরিকদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণও প্রয়োজন। শহরের ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার সমন্বয় টিকিয়ে রাখতে হলে, পরিকল্পিত এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কলকাতা যদি এই সমস্যা সমাধানে সফল হতে পারে, তবে এটি শুধুমাত্র ভারতের মধ্যেই নয়, বিশ্বের মধ্যেও একটি আদর্শ হতে পারে। তবে এর জন্য সময়, সম্পদ এবং সঠিক নীতি প্রয়োজন—যা এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্তভাবে প্রদান করা হয়নি।