নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএসআইএস)-এর ভারতীয় শাখার প্রধান এবং নিষিদ্ধ স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া (ISIS)-এর প্রাক্তন সদস্য সাকিব আব্দুল হামিদ নাচন (Saquib Nachan) শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে ব্রেন হেমারেজের কারণে মারা গিয়েছে। ৫৭ বছর বয়সী নাচন ২০২৩ সাল থেকে তিহার জেলে বিচারাধীন হেফাজতে ছিল। জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) তাকে দিল্লি ও মহারাষ্ট্রের পডঘা অঞ্চলের আইএসআইএস জঙ্গি মডিউলের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সে মঙ্গলবার থেকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিল এবং শনিবার দুপুর ১২:১০-এ তিনি মারা যায়।
নাচনের অপরাধমূলক ইতিহাস
সাকিব নাচন মহারাষ্ট্রের থানে জেলার পডঘা শহরের বাসিন্দা ছিল। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে সে এসআইএমআই-এর একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে উঠে আসে। ২০০১ সালে জাতীয় নিরাপত্তার কারণে এসআইএমআই নিষিদ্ধ হয়। নাচনের নাম প্রথম জাতীয় স্তরে আলোচনায় আসে ২০০২-২০০৩ সালে মুম্বইয়ে সংঘটিত একাধিক বোমা হামলার তদন্তের সময়। এই হামলাগুলো মুম্বই সেন্ট্রাল, ভাইল পার্লে এবং মুলুন্ড স্টেশনে সংঘটিত হয়েছিল, যাতে কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ১০০-র বেশি মানুষ আহত হয়েছিল।
নাচনের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগ আনা হয়, যার মধ্যে একটি একে-৫৬ রাইফেলও ছিল। প্রিভেনশন অব টেররিজম অ্যাক্ট (পিওটিএ)-এর অধীনে একটি বিশেষ আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। ২০১৭ সালে, ভালো আচরণের জন্য পাঁচ মাসের কম সময় কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পায়। এরপর ২০২৩ সালে, এনআইএ তাকে আবার গ্রেফতার করে, এবার দিল্লি-পডঘা আইএসআইএস জঙ্গি মডিউল মামলায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে। এনআইএ-এর অভিযোগ, নাচন ভারতে আইএসআইএস-এর ‘আমির-ই-হিন্দ’ (ভারত প্রধান) হিসেবে কাজ করছিল এবং তরুণদের উগ্রপন্থী করে তোলা, নিয়োগ, এবং বিস্ফোরক তৈরির কাজে জড়িত ছিল।
অসুস্থতা ও মৃত্যু
২০২৫ সালের ২২ জুন, তিহার জেলে থাকাকালীন নাচনের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। তাকে দ্রুত দীন দয়াল উপাধ্যায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, যেখানে চিকিৎসকরা তার ব্রেন হেমারেজ নির্ণয় করে। তার অবস্থার আরও অবনতি হলে ২৫ জুন তাকে সফদরজং হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চার দিন তীব্র পর্যবেক্ষণের পর, শনিবার সে মারা যায়৷ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তার মৃত্যুর সময় ছিল দুপুর ১২:১০। তার মৃতদেহ ময়নাতদন্তের পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে, এবং শেষকৃত্য পডঘার কাছে বোরিভালি গ্রামে রবিবার অনুষ্ঠিত হবে।
নাচনের বিতর্কিত জীবন
সাকিব নাচনের জীবন ছিল বিতর্কে ঘেরা। এসআইএমআই-এর মহারাষ্ট্র রাজ্য সভাপতি এবং পরে জাতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সে সংগঠনের একটি বড় সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছিল, যেখানে ১০,০০০-এর বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে তিনি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ভ্রমণ করে জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল বলে অভিযোগ। সিবিআই-এর একটি চার্জশিটে বলা হয়, সে ভারতীয় মুসলিম ও শিখ যুবকদের বিস্ফোরক এবং গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণে সহায়তা করেছিল। ২০০৮ সালে, তিনি ২৬/১১ মুম্বই হামলার আক্রমণকারীদের জন্য তার ব্যক্তিগত জমিতে কবর দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেন। এছাড়াও, ২০২৪ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টে আইএসআইএস নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে একটি পিটিশন দাখিল করেছিল।
এনআইএ-এর তদন্ত ও অভিযোগ
২০২৩ সালে গ্রেফতারের পর, এনআইএ অভিযোগ করে যে নাচন পুনের কোণ্ঢওয়ায় আইএসআইএস-এর একটি স্লিপার সেল পরিচালনা করছিল। সে তরুণদের উগ্রপন্থী করে তুলছিল, আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল এবং পডঘাকে একটি ‘মুক্ত অঞ্চল’ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। এনআইএ-এর চার্জশিটে বলা হয়, নাচন আইএসআইএস-এর প্রতি আনুগত্যের শপথ (বায়াত) গ্রহণের অনুষ্ঠান পরিচালনা করত এবং ভিপিএন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে এই কার্যক্রমের ভিডিও হ্যান্ডলারদের কাছে পাঠাত। ২০২৪ সালে এনআইএ ১৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে, যেখানে নাচনকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
নাচনের মৃত্যু ভারতের উগ্রবাদী নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি চিহ্নিত করলেও, এনআইএ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জঙ্গি কার্যকলাপের উপর কড়া নজর রাখছে। পডঘায় তার শেষকৃত্যের জন্য নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। নাচনের জীবন ও কার্যকলাপ ভারতে উগ্রবাদের বিস্তার এবং তরুণদের মধ্যে উগ্রপন্থী মতাদর্শের প্রভাবের একটি উদাহরণ। এটি প্রমাণ করে যে, প্রাথমিক হস্তক্ষেপ, শিক্ষা এবং সম্প্রদায়ের সংহতি এই ধরনের হুমকি মোকাবেলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নাচনের মৃত্যু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের চলমান লড়াইয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে, এটি একটি সতর্কতাও বহন করে যে, উগ্রবাদী মতাদর্শ এবং জঙ্গি নেটওয়ার্ক এখনও দেশের জন্য হুমকি। সরকার ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর উচিত এই ধরনের কার্যকলাপের উপর কঠোর নজরদারি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা। সাকিব নাচনের জীবন ও মৃত্যু ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জটিল চ্যালেঞ্জগুলোর একটি প্রতিফলন, যা শুধুমাত্র আইনি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমেই নয়, সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষার মাধ্যমেও মোকাবেলা করতে হবে।