বাংলার তথা ভারতের ভরসায় পেট ভরে আফ্রিকার বহু দেশের

আজ বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার কথা উঠলে ভারতের নাম প্রথমে আসে। বিশেষ করে চাল উৎপাদন ও রপ্তানিতে ভারত (Indian Rice Exports) একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছে,…

Indian Rice from West Bengal Feeds Millions Across African Nations

আজ বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার কথা উঠলে ভারতের নাম প্রথমে আসে। বিশেষ করে চাল উৎপাদন ও রপ্তানিতে ভারত (Indian Rice Exports) একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছে, এবং এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আফ্রিকার দেশগুলির জীবনধারণে ভারতীয় চালের অবদান। আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (IFPRI) এর ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, আফ্রিকার অনেক দেশ ভারত থেকে চাল আমদানি করে তার নাগরিকদের পেট ভরাচ্ছে। এরিত্রিয়া (৯৯.৮৫%), লাইবেরিয়া (৯৬.২৮%), গিনি (৯৩.৬২%) এবং মাদাগাস্কর (৯০.৩১%)ের মতো দেশগুলি ভারতীয় চালের ওপর প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে যে, ভারত আজ কেবল একটি উন্নয়নশীল দেশ নয়, বরং বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার একটি মূল স্তম্ভ হয়ে উঠেছে।

পশ্চিমবঙ্গের চাল উৎপাদনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা
ভারতের চাল উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই রাজ্যের গঙ্গার দুই পাড়ে বিস্তৃত ধানের চাষ হয়, যা দেশের মোট চাল উৎপাদনের এক বড় অংশ নিজেই নিশ্চিত করে। পশ্চিমবঙ্গের মোট চাষের এলাকা ৫.৫ মিলিয়ন হেক্টর, যার ৬২% ভূমি চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ৫৪% এলাকা সেচের আওতায় এবং ফসল উৎপাদনের তীব্রতা ১৭৬%। গবেষণা অনুযায়ী, রাজ্যে প্রতি হেক্টরে গড়ে ২.৬ টন চাল উৎপাদন হয়। তবে, বন্যা, খারাপ নিকাশ, মাটির অম্লতা এবং পুষ্টি সংকটের মতো সমস্যা উৎপাদন বাধা দেয়।

   

পশ্চিমবঙ্গের ধান চাষে প্রধানত আড়াই মৌসুমী (আমন), গরম মৌসুমী (আউশ) এবং শীত মৌসুমী (বোরো) ধানের চাষ হয়। গঙ্গা-ভাগীরথীর উর্বর মাটি এবং প্রাকৃতিক পানি সরবরাহ চাষিদের জন্য একটি বরदान। তবে, বর্ষার সময় বন্যা এবং শীতকালে অপ্রতুল পানি সরবরাহ চাষিদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। সরকার এবং বৈজ্ঞানিকরা বর্তমানে জৈব কৃষি এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান খুঁজছে।

আফ্রিকার জন্য ভারতের চাল রপ্তানির গল্প
২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, এরিত্রিয়ার মতো দেশে ভারতীয় চালের অংশ ৯৯.৮৫% হওয়া উল্লেখযোগ্য। এই দেশগুলির জন্য ভারতীয় চাল কেবল একটি খাদ্য নয়, বরং জীবনের একটি মৌলিক উপাদান। লাইবেরিয়া (৯৬.২৮%), গিনি (৯৩.৬২%), মাদাগাস্কর (৯০.৩১%), টোগো (৮৯.১৬%), সোমালিয়া (৮৩.৫৭%) এবং ইথিওপিয়া (৮০.১৮%)ের মতো দেশগুলিও ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা বাড়ার কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যান্য দেশ যেমন থাইল্যান্ডের উৎপাদন কমে যাওয়া।

ভারতীয় চালের গুণমান, সাশ্রয়িক দাম এবং স্থিতিশীল সরবরাহ আফ্রিকার দেশগুলির জন্য একটি বড় আকর্ষণ। তবে, এই রপ্তানির পেছনে ভারতের সরকারি নীতি ও কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারী সহায়তায় চাষিদের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি রপ্তানি সহজ করার জন্য বন্দর ও লজিস্টিক ব্যবস্থার উন্নতি করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তা
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অনেক দেশ খাদ্য উৎপাদনে লড়াই করছে। এল নিনো প্রভাবে ২০২৪ সালে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) চালের দাম ১৫% বৃদ্ধি রেকর্ড করেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের চাল রপ্তানি আফ্রিকার জন্য একটি জীবন রক্ষক হয়ে উঠেছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে, ভারতের নিজের দেশীয় চাহিদা বাড়লে রপ্তানি নীতি কঠোর হতে পারে, যা আফ্রিকার দেশগুলির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হবে।

Advertisements

পশ্চিমবঙ্গে বন্যা ও মাটির অম্লতা কমাতে গবেষকরা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। জৈব সার এবং স্মার্ট সেচ পদ্ধতি চাষিদের জন্য উৎপাদন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই উদ্যোগগুলো ভারতকে আফ্রিকার জন্য চাল সরবরাহ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দেবে।

ভারত-আফ্রিকা সহযোগিতার ভবিষ্যৎ
ভারতের ২০২৩ সালের জি২০ সভাপতিত্বে আফ্রিকান ইউনিয়নকে স্থায়ী সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ছিল। এই সহযোগিতা খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উন্নয়নে ভারত ও আফ্রিকার মধ্যে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা গড়ে তুলবে। ভারতের সবুজ বিপ্লব ও দুধ উৎপাদনের সাফল্য আফ্রিকার জন্য একটি মডেল হতে পারে।

আফ্রিকার দেশগুলো ভারতের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং ভারতও তাদের স্থানীয় সমস্যা সমাধানে সহায়তা করতে পারে। পুষ্টি সুরক্ষা, বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য, উভয় দেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এই ক্ষেত্রে যৌথ প্রকল্প গড়ে তুলতে পারে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আফ্রিকার জন্য একটি আশার আলো হয়ে উঠেছে। গঙ্গার দুই পাড় থেকে শুরু করে আফ্রিকার বাড়িতে চাল পৌঁছানোর এই যাত্রা একটি সাফল্যের গল্প। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন ও দেশীয় চাহিদার চাপ মোকাবিলায় সরকার ও চাষিদের একত্রে কাজ করা জরুরি। ভারত-আফ্রিকা সহযোগিতা শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, বরং মানবিক সম্পর্কের একটি নতুন দ্বার খুলবে।