ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর (jaishankar) সম্প্রতি ইউরোপীয় নিউজ সাইট ইউরাকটিভ-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাতকে কেবল দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা উচিত নয়। তিনি বলেন, এটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, যা শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বকেও বিপদে ফেলবে। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর ভারতের অপারেশন সিঁদুরের প্রেক্ষিতে ইউরোপ সফরের সময় তিনি এই মন্তব্য করেন।
পহেলগাঁও হামলা ও ভারতের অবস্থান (jaishankar)
গত এপ্রিলে কাশ্মীরের পহেলগাঁও জঙ্গি হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। জয়শঙ্কর বলেন, “আমি আপনাদের একটি বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই – ওসামা বিন লাদেন নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন।
তিনি (jaishankar) কেন পাকিস্তানের একটি সামরিক শহরে, তাদের ওয়েস্ট পয়েন্টের সমতুল্য এলাকায় বছরের পর বছর নিরাপদে বসবাস করতে পেরেছিলেন?” তিনি আরও বলেন, “আমি বিশ্বকে বোঝাতে চাই, এটি কেবল ভারত-পাকিস্তান ইস্যু নয়। এটি সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে। এবং এই সন্ত্রাসবাদই শেষ পর্যন্ত আপনাদের দিকে ফিরে আসবে।”
জয়শঙ্কর (jaishankar) ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লিয়েন এবং ইইউ পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান কাজা কালাসের সঙ্গে বৈঠকে ভারতকে একটি নির্ভরযোগ্য এবং মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভারত মুক্ত বাণিজ্য আলোচনার প্রেক্ষিতে ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব তুলে ধরেন।
ভারতের বিশ্বব্যাপী অবস্থান
জয়শঙ্কর (jaishankar) বলেন, “১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারত দক্ষ শ্রমশক্তি এবং চীনের তুলনায় আরও বিশ্বস্ত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব প্রদান করে।” তিনি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর চীনা সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতি ক্রমবর্ধমান সতর্কতার কথা উল্লেখ করে বলেন, “অনেক কোম্পানি তাদের ডেটা কোথায় রাখবে তা নিয়ে সতর্ক হচ্ছে। তারা নিরাপদ এবং বিশ্বস্ত স্থানে ডেটা রাখতে চায়।” এর মাধ্যমে তিনি ভারতকে একটি নিরাপদ বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের বিষয়ে জয়শঙ্কর (jaishankar) ভারতের অ-নির্দেশাত্মক অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি না যে যুদ্ধের মাধ্যমে পার্থক্য সমাধান করা যায়। আমাদের জন্য সমাধান কী হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করা নয়। আমরা বিচারক বা নির্দেশক নই, তবে আমরা সম্পূর্ণ উদাসীনও নই।”
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ভারতের অবস্থানের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের ইউক্রেনের সঙ্গেও শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। এটি কেবল রাশিয়ার বিষয় নয়। প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ইতিহাস এবং স্বার্থ বিবেচনা করে।”
পশ্চিমা নীতির ঐতিহাসিক সমালোচনা
জয়শঙ্কর (jaishankar) পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি ভারতের ঐতিহাসিক অভিযোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “ভারতের স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যেই আমাদের সীমান্ত লঙ্ঘন করা হয়েছিল। এবং সেই সময়ে সবচেয়ে বেশি সমর্থনকারী দেশগুলো কারা ছিল? পশ্চিমা দেশগুলো।” তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, যারা তখন নিশ্চুপ বা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তারা এখন আন্তর্জাতিক নীতির কথা বলে কীভাবে নৈতিক অবস্থান নেয়?
তিনি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থার প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, “বহুমুখী বিশ্ব ইতিমধ্যেই এখানে রয়েছে। ইউরোপকে এখন তার নিজস্ব স্বার্থে আরও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” তিনি উল্লেখ করেন, ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ শব্দটি, যা এখন ইউরোপে জনপ্রিয়, একসময় ভারতের কূটনৈতিক শব্দভাণ্ডারের অংশ ছিল।
ইইউ’র জলবায়ু নীতির সমালোচনা
জয়শঙ্কর (jaishankar) ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম (সিবিএএম) নীতির কিছু দিকের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, “আমরা এর কিছু অংশের বিরোধী। বিশ্বের একটি অংশ সবার জন্য মান নির্ধারণ করবে, এই ধারণার আমরা বিরুদ্ধে।” এই নীতি ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার বিষয়ে জয়শঙ্কর (jaishankar) বলেন, “আমি বিশ্বকে যেমন পাই তেমন গ্রহণ করি। আমাদের লক্ষ্য হল প্রতিটি সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যা আমাদের স্বার্থে কাজ করে। মার্কিন সম্পর্ক আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোনো ব্যক্তি বা প্রেসিডেন্টের বিষয় নয়।”
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সতর্কতা
জয়শঙ্কর (jaishankar) পহেলগাঁও হামলার পর ভারতের সামরিক পদক্ষেপ অপারেশন সিন্দুরের প্রেক্ষিতে বলেন, এটি কেবল দুই দেশের দ্বন্দ্ব নয়, বরং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। তিনি পশ্চিমা বিশ্বকে সতর্ক করে বলেন, “যে সন্ত্রাসবাদ আমরা মোকাবিলা করছি, তা একদিন আপনাদের দিকেও ফিরে আসবে।” তিনি পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের প্রতি নীরব সমর্থনের ইতিহাস তুলে ধরে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
ভারত-ইইউ অর্থনৈতিক সম্পর্ক
ইইউ-ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আলোচনার প্রেক্ষিতে জয়শঙ্কর (jaishankar) ভারতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “ভারতের ১৪০ কোটি জনসংখ্যা এবং দক্ষ শ্রমশক্তি আমাদেরকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার করে।” তিনি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর জন্য ভারতকে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করেন।
এস জয়শঙ্করের (jaishankar) ইউরোপ সফর এবং তার সাক্ষাৎকার ভারতের বৈশ্বিক অবস্থানকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টার অংশ। তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান, ভারতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং পশ্চিমা নীতির সমালোচনার মাধ্যমে ভারতের কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
এবার রাষ্ট্রপতির কাছে দরখাস্ত নির্দোষ চাকরিহারাদের
পহেলগাঁও হামলার প্রেক্ষিতে তার বক্তব্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা এবং ভারতের কৌশলগত গুরুত্বের প্রমাণ। ভারত-ইইউ সম্পর্ক এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান এই সফরে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল। আগামী দিনে এই সফর ভারতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।