সৌরভ রায়, শিলিগুড়ি: উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ি (Naxalbari) এলাকায় ফের লোকালয়ে হাতির দলের তাণ্ডব। শুক্রবার গভীর রাতে টুকরিয়াঝাড় জঙ্গল সংলগ্ন বেঙ্গাইজোত এলাকায় শাবকসহ ১৯টি হাতির একটি দল ধানের জমিতে ঢুকে পড়ে। এই ঘটনায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় কৃষকদের ধানের জমি। হাতির দল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ধানের জমিতে প্রবেশ করে ফসল নষ্ট করে এবং পরে কলাবাড়ি জঙ্গলের দিকে চলে যায়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ এবং উদ্বিগ্ন স্থানীয় বাসিন্দারা বন দপ্তরকে খবর দিলে বনকর্মী এবং স্থানীয়দের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হাতির দলটিকে জঙ্গলে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়।
ঘটনার বিবরণ
শুক্রবার রাত প্রায় ১১টার দিকে বেঙ্গাইজোত এলাকার ধানের জমিতে হাতির দলের প্রবেশের খবর ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় কৃষকরা প্রথমে হাতির উপস্থিতি টের পান এবং তৎক্ষণাৎ কার্সিয়াং বন বিভাগের টুকরিয়াঝাড় রেঞ্জে খবর দেন। বন দপ্তরের তরফে জানানো হয়েছে, হাতির দলটিতে শাবকসহ মোট ১৯টি হাতি ছিল। এই দলটি টুকরিয়াঝাড় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ধানের জমিতে প্রবেশ করে ফসল খাওয়া এবং তছনছ করার কাজ শুরু করে। এই ঘটনায় কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, কারণ ধান তাঁদের জীবিকার প্রধান উৎস।
বনকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে স্থানীয়দের সহায়তায় হাতির দলটিকে কলাবাড়ি জঙ্গলের দিকে গাইড করেন। মশাল, শব্দ এবং অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করে হাতিগুলোকে লোকালয় থেকে জঙ্গলে ফেরত পাঠানো হয়। তবে, এই ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর না পাওয়া গেলেও, কৃষকদের ফসলের ক্ষতি এবং হাতির আক্রমণের ভয় স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
হাতির তাণ্ডবের পেছনের কারণ
উত্তরবঙ্গে হাতির লোকালয়ে প্রবেশের ঘটনা নতুন নয়। জঙ্গলের খাদ্য ও পানির অভাব, বনাঞ্চলের সংকোচন এবং মানুষের বসতি বৃদ্ধির কারণে হাতির দল প্রায়ই লোকালয়ে চলে আসে। বেঙ্গাইজোত এলাকার ধানের জমি হাতিদের জন্য সহজলভ্য খাদ্যের উৎস, যা তাদের আকৃষ্ট করে। বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, “শাবকসহ হাতির দল সাধারণত খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। এই সময় ধানের জমি তাদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।” তবে, এই ঘটনাগুলো কৃষকদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কৃষকদের ক্ষতি ও উদ্বেগ
বেঙ্গাইজোতের কৃষকদের জন্য ধান তাঁদের জীবিকার প্রধান ভরসা। হাতির দলের এই তাণ্ডব তাঁদের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। স্থানীয় কৃষক রমেশ রায় বলেন, “আমাদের সারা বছরের পরিশ্রম এই হাতির দল ধ্বংস করে দিল। ফসল না থাকলে আমরা কীভাবে চলব?” আরেক কৃষক, মিনতি মণ্ডল, বলেন, “হাতির ভয়ে আমরা রাতে ঘুমোতে পারি না। বন দপ্তরের উচিত এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা।”
বন বিভাগের প্রতিক্রিয়া
কার্সিয়াং বন বিভাগের টুকরিয়াঝাড় রেঞ্জের আধিকারিকরা জানিয়েছেন, তারা হাতির গতিবিধি নজরে রাখছেন। হাতির দলটিকে জঙ্গলে ফেরত পাঠানো হলেও, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। তবে, হাতি-মানুষ সংঘাত কমাতে জঙ্গলে খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন।” বন বিভাগ এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয়দের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রচার চালাচ্ছে।
সমাধানের পথ
হাতি-মানুষ সংঘাত কমাতে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। জঙ্গলে পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা করা, হাতির চলাচলের করিডোর সংরক্ষণ এবং কৃষকদের জন্য বৈদ্যুতিক বেড়া বা অন্যান্য প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। স্থানীয়রা দাবি করেছেন, বন দপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা উচিত।
নকশালবাড়ির বেঙ্গাইজোত এলাকায় হাতির দলের তাণ্ডব কৃষকদের জন্য একটি বড় ধাক্কা। শাবকসহ ১৯টি হাতির এই দল ধানের জমি নষ্ট করে কৃষকদের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বন বিভাগ এবং স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় হাতিগুলো জঙ্গলে ফিরিয়ে নেওয়া গেলেও, এই ঘটনা উত্তরবঙ্গে হাতি-মানুষ সংঘাতের সমস্যার গভীরতা তুলে ধরেছে। কৃষকদের ক্ষতিপূরণ এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন। এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে আরও পরিকল্পিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।