শত্রুপক্ষের ঘুম উড়িয়ে এক টেবিলে তুলসী-রাজনাথ

নয়াদিল্লি, ১৭ মার্চ ২০২৫: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক (ডিএনআই) তুলসী গ্যাবার্ড (Tulsi Gabbard) সোমবার নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন।…

Tulsi Gabbard Meets Rajnath Singh

short-samachar

নয়াদিল্লি, ১৭ মার্চ ২০২৫: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক (ডিএনআই) তুলসী গ্যাবার্ড (Tulsi Gabbard) সোমবার নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গ্যাবার্ড ভারতে দুই দিনেরও বেশি সময়ের একটি সফরে এসেছেন, যা ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার প্রথম উচ্চ-পর্যায়ের ভারত সফর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

   

সূত্রের খবর, সিং এবং গ্যাবার্ডের মধ্যে এই বৈঠকে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে সমন্বয় জোরদার করার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এই সফর এবং বৈঠক ভারত-মার্কিন সম্পর্কের কৌশলগত গুরুত্বকে আরও একবার তুলে ধরেছে, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।

তুলসী গ্যাবার্ড রবিবার ভোরে ভারতের রাজধানীতে পৌঁছেছেন। এই সফরে তিনি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত দোভালের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। দোভালের সঙ্গে তার আলোচনায় গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি এবং ভারত-মার্কিন গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপের আওতায় নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার উপর জোর দেওয়া হয়। এরপর সোমবার দক্ষিণ ব্লকে রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে তার বৈঠক এই সম্পর্ককে আরও গভীর করার একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৫ সালে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব শুরু হয় এবং ২০২০ সালে ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় এটি একটি ব্যাপক গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপে উন্নীত হয়। গ্যাবার্ডের এই সফর এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার একটি প্রতিফলন।

রাজনাথ সিং এবং তুলসী গ্যাবার্ডের বৈঠকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, সাইবার নিরাপত্তা এবং উদীয়মান হুমকির মতো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই বৈঠকে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে যৌথ মহড়া, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের বিষয়েও কথা হয়েছে।

ভারত সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের দিকে ঝুঁকেছে। লজিস্টিকস এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অফ অ্যাগ্রিমেন্ট (LEMOA), কমিউনিকেশনস কম্প্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাগ্রিমেন্ট (COMCASA) এবং বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (BECA)-এর মতো চুক্তিগুলি দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। গ্যাবার্ডের সঙ্গে এই আলোচনা এই সহযোগিতাকে আরও এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।

তুলসী গ্যাবার্ডের এই সফর তার ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের একটি বৃহত্তর সফরের অংশ, যার মধ্যে জাপান, থাইল্যান্ড এবং ফ্রান্সও রয়েছে। তিনি রবিবার ভারতে পৌঁছানোর পর অজিত দোভালের সঙ্গে একটি উচ্চ-পর্যায়ের নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নেন, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে সন্ত্রাসবাদ এবং নতুন প্রযুক্তি থেকে উদ্ভূত হুমকি মোকাবিলায় সহযোগিতা বাড়ানোর উপর জোর দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) গ্যাবার্ড রাইসিনা ডায়ালগে একটি প্রধান বক্তৃতা দেবেন। এই সম্মেলন ভারতের শীর্ষ ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক সম্মেলন হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এখানে তিনি ভারতীয় কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।

গ্যাবার্ডের এই সফর মোদীর গত ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সেই সফরে মোদী গ্যাবার্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাকে ভারত-মার্কিন বন্ধুত্বের একজন “দৃঢ় সমর্থক” হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। গ্যাবার্ডও মোদীকে স্বাগত জানিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন।

৪৩ বছর বয়সী তুলসী গ্যাবার্ড মার্কিন কংগ্রেসের প্রথম হিন্দু সদস্য হিসেবে পরিচিত। তিনি হাওয়াই থেকে ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি হিসেবে কংগ্রেসে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২২ সালে তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ত্যাগ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করেন এবং এখন তার প্রশাসনে জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ভগবদ্গীতার হাতে শপথ নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন এবং ২০১৯ সালে মোদীকে সেই বইটি উপহার দিয়েছিলেন।

গ্যাবার্ড ভারতের প্রতি তার সমর্থনের জন্য পরিচিত। তিনি ২০১৪ সালে মোদীর আমন্ত্রণে ভারত সফর করেছিলেন এবং আন্তর্জাতিক যোগ দিবসের প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর নির্যাতনের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন, যা ভারতীয়-মার্কিন সম্প্রদায়ের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে।

এই বৈঠক ভারতীয় এবং মার্কিন ক্রীড়াপ্রেমীদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। সামাজিক মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “ভারত-মার্কিন সম্পর্কের এই নতুন ধাপ আমাদের জন্য গর্বের। গ্যাবার্ডের সঙ্গে রাজনাথ সিংয়ের বৈঠক শক্তিশালী ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়।” বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সফর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় দুই দেশের যৌথ প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করবে।

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, “এই আলোচনা দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়গুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তায় আরও গভীর সহযোগিতার দিকে এগোচ্ছি।”

তুলসী গ্যাবার্ড এবং রাজনাথ সিংয়ের এই বৈঠক ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্কের একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গ্যাবার্ডের সফর এবং তার আলোচনা দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। এই সম্পর্ক শুধুমাত্র দুই দেশের জনগণের জন্যই নয়, বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে এই সহযোগিতা কীভাবে ফলপ্রসূ হয়, তা সময়ই বলবে, তবে এই বৈঠক নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।