প্রসেনজিৎ চৌধুরী: নিজের বক্তব্যই কাল হল (Sheikh Hasina) শেখ হাসিনার। ছাড়তে হল ক্ষমতা। গণবিক্ষোভে বাংলাদেশে শেষ হয়ে গেছে শেখ শাসন! বিক্ষোভে ভীত হয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে এসেছেন বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী। ভারতে তিনি আগেও নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনার পিতা ও ততকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশেরই সেনাবাহিনীর একাংশ খুন করেছিল। ঢাকায় সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন মুজিবুর রহমান। তবে দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যেহেতু বিদেশে ছিলেন তাই বেঁচে গেছিলেন। তাঁদের ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। নয়াদিল্লিতেই স্বামী, পুত্র কন্যা ও বোনকে নিয়ে থাকতেন হাসিনা।
১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দিল্লিতে রাজনৈতিক নির্বাসন কাটিয়ে বাংলাদেশে ফিরেছিলেন শেখ হাসিনা। তারপর জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরোধী গণআন্দোলনে নেমেছিলেন বা়ংলাদেশের বিরোধী নেত্রী হন। পরে বারবার সরকার গড়েছেন শেখ হাসিনা। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী নারী নেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন। সর্বশেষ নির্বাচনে বিপুল জয় পেলেও জনতার বিক্ষোভে তাঁকে দেশ ছাড়তে হল।
‘রাজাকার’ শব্দটি বাংলাদেশে চরম ঘৃণিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থনকারীদের রাজাকার বলে চিহ্নিত করা হয়। এই শব্দ নিয়ে একটি বেফাঁস মন্তব্যই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে আসন সংরক্ষণের নিয়ম সংশোধনের দাবিতে পড়ুয়াদের আন্দোলনকে কটাক্ষ করেছিলেন শেখ হাসিনা। কোটা বিরোধী এই আন্দোলন শুরু হয় গত ৫ জুলাই। শুরু হয় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ। বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে ৩০ শতাংশ ছিল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য। পড়ুয়ারা দাবি করে কোটা নয় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হোক।
গত ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? এই মন্তব্যের পর আন্দোলন সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে ১৫ জুলাই থেকে। কোটা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে মর্মাহত ও অপমানিত বোধ করায় স্লোগানে স্লোগানে প্রতিক্রিয়া দেখান। তারা বলেন ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, আমরা সবাই রাজাকার বলেছে স্বৈরাচার।
দলনেত্রী শেখ হাসিনার সমর্থনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঔদ্ধত্বের জবাব দেবে ছাত্রলীগ’। সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্র লীগের সংঘর্ষ হয়। এর প্রতিবাদে ১৬ জুলাই বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। সেদিনই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিতে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়।
১৭ জুলাই জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তার বিশ্বাস শিক্ষার্থীরা আদালতে ন্যায়বিচার পাবে। পরের দিন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির ডাক আসে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। সেদিন ঢাকায় কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
এর মাঝে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কোটা বদলে ৯৩ শতাংশ মেধার নিয়ম জারি হয়। তবে ছাত্র আন্দোলনে হামলার জেরে বাংলাদেশে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ দমনে পুলিশের গুলি চালানো ও সরকারি দলের তরফে হামলার জেরে রক্তাক্ত পরিস্থিতি হয়ে যায়।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মঞ্চ থেকে সরকার পতনের দাবিও সামনে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেসময় আলোচনার জন্য ডাকলেও আন্দোলনকারীরা প্রত্যাখ্যান করেন।
৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। পরের দিন রবিবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।শতাধিক নিহত হন। বিক্ষোভকারীরা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির সোমবার, ৫ আগস্ট ঘোষণা করেন। কারফিউ জারি হলেও বিক্ষোভ থামেনি।
সোমবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে লেখা হয়ে গেলে হাসিনার পতন কাহিনী। গণবিক্ষোভে নিজের সরকারি বাসভবন গণভবন ছেড়ে সেনাবাহিনীর সাহায্যে ভারতে চলে আসেন শেখ হাসিনা। শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশে শেখশাহি! সেই ১৯৭৫ সালের পর ২০২৪ সালে ফের নির্বাসিত শেখ হাসিনা।